পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পূর্ব্বে ভারতী বলিল, সবই আছে, কেবল মোমবাতি ফুরিয়ে গেছে, আমি নীচে থেকে এক বাণ্ডিল কিনে দিয়ে যাচ্ছি, এই বলিয়া সে নিঃশব্দে দ্বার খুলিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। মিনিট কয়েক পরে বাতি লইয়া যখন ফিরিয়া আসিল, তখন কতকটা পরিমাণে বোধ হয় আপনাকে অপূর্ব্ব সামলাইয়া লইতে পারিয়াছিল। চোখ মুছা শেষ হইয়াছে, কিন্তু ভিজা পাতার নীচে সে দুটি রাঙা হইয়া আছে। ভারতী ঘরে ঢুকিতেই সে আর একদিকে মুখ ফিরাইয়া লইল। হাতের মোড়কটি কাছে রাখিয়া দিয়া কি যেন সে একবার বলিতে চাহিল। কিন্তু আর একজন যখন কথা না কহিয়া মুখ ফিরাইয়া লইল, তখন সেও আর প্রশ্ন না করিয়া পলকমাত্র নিঃশব্দে থাকিয়া প্রস্থানের জন্য দ্বার খুলিতেই অপুর্ব্ব অকস্মাৎ বলিয়া উঠিল, তেওয়ারী যদি জল খেতে চায়?

 ভারতী ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, জল দেবেন।

 অপূর্ব্ব কহিল, আর যদি পাশ ফিরে শুতে চায়?

 ভারতী বলিল, পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দেবেন।

 বলা ত সহজ। আমি শোব কোথায় শুনি? তাহার কণ্ঠস্বরের ক্রোধ চাপা রহিল না, কহিল, বিছানা ত রইল ওপরের ঘরে।

 ভারতী কি মনে করিল তাহার মুখ দেখিয়া বুঝা গেল না। এক মুহূর্ত্ত স্থির থাকিয়া তেমনি শান্ত-মৃদুকণ্ঠে কহিল, আর একটা বিছানা ত আপনার খাটের ওপরে আছে, তাতে ত অনায়াসে শুতে পারবেন।

 অপূর্ব্ব কহিল, আপনি ত বলবেনই ও-কথা। আর আমার খাবার বন্দোবন্ত কি রকম হবে?

 ভারতী চুপ করিয়া রহিল, কিন্তু এই অসঙ্গত ও অত্যন্ত খাপছাড়া প্রশ্নে গোপন হাসির আবেগে তাহার চোখের পাতা দুটি যেন কাঁপিতে লাগিল। খানিক পরে পরম গাম্ভীর্য্যের সহিত কহিল, আপনার শোওয়া এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করার ভার কি আমার ওপরে আছে?

 তাই কি আমি বলচি?

 এই মাত্র ত বললেন, এবং ভাল করে নয়, রাগ করে?

 অপূর্ব্ব ইহার উত্তর খুঁজিয়া পাইল না। তাহার মলিন বিপন্ন মুখের প্রতি চাহিয়া ভারতী ধীরে ধীরে কহিল, আপনার বলা উচিত ছিল, দয়া করে আমার এইসব বিলিব্যবস্থা আপনি করে দিন।

 অপূর্ব্ব কোন দিকে না চাহিয়া কহিল, তা বলা আর শক্ত কি?

 ভারতী কহিল, বেশ ত, তাই বলুন না।

৭০