পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বিছানায় উঠিয়া বসিয়া সম্মুখের ঘড়িতে চাহিয়া দেখিল রাজি বারোটা বাজিয়া গেছে। ভারতী পাশে দাঁড়াইয়া। অপূর্ব্বর প্রথম দৃষ্টি পড়িল তাহার চুলের আয়তন ও দীর্ঘতার প্রতি। সদ্যস্নান-সিক্ত বিপুল কেশভার ভিজিয়া যেমন নিবিড় কালো হইয়াছে, তেমনি ঝুলিয়া প্রায় মাটিতে পড়িয়াছে। স্নিগ্ধ সাবানের গন্ধে ঘরের সমস্ত রুদ্ধ বায়ু হঠাৎ যেন পুলকিত হইয়া উঠিয়াছে। পরণে একখানি কালো পাড়ের সুতার শাড়ি, গায়ে জামা না থাকায় বাহুর অনেকখানি দেখা যাইতেছে;—ভারতীর এ যেন আর এক নূতন মূর্ত্তি, অপূর্ব্ব পূর্ব্বে কখনো দেখে নাই। তাহার মুখ দিয়া প্রথমেই বাহির হইল, এত ভিজে চুল শুকোবে কি করে?

 ভারতী কহিল, শুকোবে না। কিন্তু সে জন্যে ভাবতে হবে না, আপনি আসুন দিকি আমার সঙ্গে।

 তেওয়ারী কেমন আছে?

 ভাল আছে। অন্ততঃ, আজ রাত্রির মত আপনাকে ভাবতে হবে না, আসুন।

 তাহার সঙ্গে সঙ্গে অপূর্ব্ব স্নানের ঘরে আসিয়া দেখিল ছোট একটি টুকরিতে কতকগুলি ফল-মূল, একটা বঁটি, একটা থালা, একটা গেলাস,—ভারতী দেখাইয়া কহিল, এর বেশী করা ত চলবে না। কলের জলে সমস্ত ধুয়ে ফেলুন বঁটি, থালা, গেলাস সব। গেলাসে করে জল নিন, নিয়ে ও-ঘরে আসুন, আমি আসন পেতে রেখেচি।

 অপূর্ব্ব জিজ্ঞাসা করিল, এ সকল আপনি কখন আনলেন?

 ভারতী বলিল, আপনি ঘুমোলে। কাছেই একটা ফলের দোকান আছে, দূরে যেতে হয়নি। আর টুকুরিটা ত আপনাদেরই। এই বলিয়া সে অন্যত্র চলিয়া গেল, শুধু সতর্ক করিয়া দিয়া গেল, বঁটি ধুইতে গিয়া যেন হাত না কাটে।

 খানিক পরে আসনে বসিয়া অপূর্ব্ব ফল কাটিতেছিল এবং ভারতী অদূরে বসিয়া হাসিতেছিল। অপূর্ব্ব কহিল, আপনি হাসুন ক্ষতি নেই। পুরুষমানুষে বঁটিতে কাটতে পারে না সবাই জানে। কিন্তু আপনি আমার খাবার জন্যে যে যত্ন করেচেন সে জন্যে আপনাকে সহস্র ধন্যবাদ। মা ছাড়া এমন আর কেউ করতেন না।

 তাহার শেষ কথাটা ভারতী কানেই তুলিল না। আগের কথার উত্তরে কহিল, হাসি কি সাধে অপূর্ব্ব বাবু! পুরুষমানুষে বঁটিতে কাটতে পারে না সবাই জানে সত্যি, কিন্তু তাই বলে এমনটি কি সবাই জানে? তেওয়ারী ভাল হয়ে গেলে মাকে আমি নিশ্চয়ই চিঠি লিখে দেব, হয় তিনি আসুন, না হয় ছেলেকে তাঁর ফিরিয়ে নিয়ে যান। এ মানুষকে বাইরে ছেড়ে রাখা চলবে না।

 অপূর্ব্ব কহিল, মা তাঁর ছেলেকে ভাল করেই জানেন। কিন্তু দেখুন, আমি

৭৫