পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কোন একটা ছল-ছুতায় ব্রাহ্মণাদি ভোজন করাইয়া দেহটাকে কাজ-চলা-গোছের শুদ্ধ করিয়া লইবে। কিন্তু ঘাঁটাঘাঁটি করিয়া কথাটাকে একবার মায়ের কানে তুলিয়া দিলে যে কিসে কি দাঁড়াইবে তাহার কিছুই বলা যায় না। হালদার বাড়ির চাকরি ও ঘুচিবেই, এমন কি তাহাদের গ্রামের সমাজ পর্য্যন্ত গিয়া টান ধরাও বিচিত্র নয়।

 কিন্তু ইহাই তেওয়ারীর সবটুকু ছিল না। এই স্বার্থ ও ভয়ের দিক ছাড়া তাহার অন্তরের আর একটা দিক ছিল যেমন মধুর, তেমনি বেদনায় ভরা। অপূর্ব্ব অফিসে চলিয়া গেলে দুপুরবেলায় সে প্রত্যহ একখানি বেতের মোড়া লইয়া বারান্দায় আসিয়া বসিত। দুর্ব্বল দেহটিকে দেওয়ালের গায়ে এলাইয়া দিয়া গলির যে অংশটি গিয়া বড় রাস্তায় মিলিয়াছে সেইখানে একদৃষ্টে চাহিয়া থাকিত। এই পথে ভারতীর কোনদিন প্রয়োজন হইবে না, ওই মোড় অতিক্রম করিবার বেলা অভ্যাসবশতঃ একবার এদিকে সে চাহিবে না, এমন হইতেই পারে না। অপূর্ব্ব ভামোয় চলিয়া গেলে এই মেয়েটির সহিত তাহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয় যেদিন দুপুরবেলা হঠাৎ তাহার মা মরিয়া যায়। তখনও তেওয়ারীর খাওয়া হয় নাই, মেয়েটা কাঁদিয়া আসিয়া তাহার রুদ্ধ দ্বারে করাঘাত করে। দিন-দুই পূর্ব্বে জোসেফ সাহেব মরিয়াছে, তাহার সে ভয় ছিল না, আসিয়া কপাট খুলিতেই ভারতী ঘরে ঢুকিয়া তাহার দুই হাত ধরিয়া সে কি কান্না! কে বলিবে সে ম্লেচ্ছ, কে বলিবে সে ক্রীশ্চানের মেয়ে! তেওয়ারীর রাঁধা ভাত হাঁড়িতেই রহিল, সারাদিন চিঠি লইয়া তাহাকে কোথায় না সেদিন ঘুরিয়া বেড়াইতে হইল। পরদিন কফিন লইয়া যাইবার বেলা এই বারান্দায় দাঁড়াইয়া চোখের জল যেন তাহার আর থামিতেই চাহে না। এই সময় হইতে ভারতীকে সে কখনো মা, কখনো দিদি বলিতে শুরু করিয়াছিল। এবং জোর করিয়া তাহাকে সে চার-পাঁচদিন রাঁধিতে দেয় নাই, নিজে রাঁধিয়া খাওয়াইয়াছিল। তারপরে যেদিন ভারতী জিনিসপত্র লইয়া স্থানান্তরে গেল, সেদিন সন্ধ্যাবেলাটা তাহার যেন আর কাটিবে না এমনি মনে হইয়াছিল। তাহার বসন্ত রোগে ভারতী কতখানি কি করিয়াছিল তাহা সে ভাল জানিতও না, ভাবিতও না। মনে হইলেই মনে হইত জাত যাইবার কথা। কিন্তু এই সঙ্গেই আয় একটা কথা সে সর্ব্বদাই ভাবিবার চেষ্টা করিত। সকালবেলা স্নান করিয়া মস্ত ভিজা চুলের রাশি পিঠে মেলিয়া দিয়া সে একবার করিয়া তেওয়ারীয় তত্ত্ব লইতে আসিত। রান্নাঘরেও ঢুকিত না, কোন কিছু স্পর্শ করিত না, চৌকাঠের বাহিরে মেঝের উপর বসিয়া পড়িয়া বলিত, আজ কি কি রাঁধলে দেখি তেওয়ারী।

 দিদি, একটা আসন পেতে দিই।

৮০