পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 অপূর্ব্ব প্রশ্ন করিল, আপনার সঙ্গে তেওয়ারীর বোধ হয় দেখা হয়, না?

 ভারতী মাথা নাড়িয়া বলিল, না। কিন্তু আপনি যেন গিয়ে তার ওপর দিছে রাগ করবেন না।

 অপূর্ব্ব কহিল, মিছে না হোক, সত্যি রাগ করা উচিত। আপনি তার প্রাণ দিয়েচেন এটুকু কৃতজ্ঞতা তার থাকা উচিত ছিল।

 ভারতী বলিল, নিশ্চয়ই আছে। নইলে, সে তো আমাকে জেলে পাঠাবার একবার অন্ততঃ চেষ্টা করেও দেখতো।

 অপূর্ব্ব এ ইঙ্গিত বুঝিল। আনতমুখে ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া শেষে বলিল, আপনি আমার উপর ভয়ানক রাগ করে আছেন।

 ভারতী বলিল, কখ্‌খনো না। সারাদিন ইস্কুলে ছেলেমেয়ে পড়িয়ে, ঘরে ফিরে আবার সমিতির সেক্রেটারির কাজে অসংখ্য চিঠিপত্র লিখে, বিছানায় শুতে-না-শুতেই ত ঘুমিয়ে পড়ি,—রাগ করবার সময় কোথায় আমার?

 অপূর্ব্ব কহিল, ওঃ—রাগ করবারও সময়টুকু নেই?

 ভারতী বলিল, কই আর আছে। আপনি বরঞ্চ কোনদিন সকাল থেকে এসে দেখবেন সত্যি না মিছে!

 অপূর্ব্বর মুখ দিয়া অলক্ষিত একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িল। কহিল, দেখবার আমার দরকার কি! একটুখানি থামিয়া কহিল, ইস্কুলে আপনাকে কত মাইনে দেয়?

 ভারতী হাসি চাপিয়া গম্ভীর হইয়া কহিল, বেশ ত আপনি। মাইনের কথা বুঝি কাউকে জিজ্ঞাসা করতে আছে? এতে তার অপমান হয় না?

 অপূর্ব্ব ক্ষুণ্ণকণ্ঠে কহিল, অপমান করবার জন্যে ত আর বলিনি। চাকরিই যখন করচেন—

 ভারতী কহিল, না করে কি শুকিয়ে মরতে বলেন?

 অপূর্ব্ব বলিল, ও যা চাকরি, এই ত শুকিয়ে মরা! তার চেয়ে বরঞ্চ আমাদের আফিসে একটা চাকরি আছে, মাইনে একশ’ টাকা—হয়ত দু-এক ঘণ্টার বেশী খাটতেও হবে না।

 ভারতী প্রশ্ন করিল, আমাকে সেই চাকরি করতে বলেন?

 অপূর্ব্ব কহিল, দোষই বা কি?

 ভারতী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না, আমি করব না। আপনি ও তার কর্ত্তা, কাজে ভুলচুক হলেই লাঠি হাতে দরজায় এসে দাঁড়াবেন।

 অপূর্ব্ব জবাব ছিল না। সে মনে মনে বুঝিল, ভারতী শুধু পরিহাস করিয়াছে, তথাপি তাহার সেই একটা দিনের আচরণের ইঙ্গিত করায় তাহার গা জ্বলিয়া গেল।

৮৮