পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

গনিয়া দেখিল ছয়জন রমণী এবং আটজন পুরুষে মিলিয়া এই ভীষণ আলোচনা চলিতেছে। ইহাদের সকলেই অচেনা কেবল একটি ব্যক্তিকে অপূর্ব্ব চক্ষের পলকে চিনিতে পারিল। বেশভূষার কিছু পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে বটে, কিন্তু এই মূর্ত্তিকেই সে কিছুকাল পূর্ব্বে মিক্‌থিলা রেলওয়ে স্টেশনে টিকিট না কেনার দায় হইতে পুলিশের হাত হইতে রক্ষা করিয়াছিল এবং টাকাটা যত শীঘ্র সম্ভব ফিরাইয়া দিতে যিনি স্বেচ্ছায় প্রতিশ্রুত হইয়াছিলেন। লোকটি চাহিয়া দেখিল, কিন্তু মদের নেশায় যাহার কাছে হাত পাতিয়া উপকার গ্রহণ করিয়াছিলেন, মদ না-খাওয়া অবস্থায় তাহাকে স্মরণ করিতে পারিলেন না। কিন্তু ইহার জন্য নয়, ভারতীকে মনে করিয়া তাহার বুকে এই ব্যথাটা অতিশয় বাজিল যে এরূপ সংসর্গে সে আসিয়া পড়িল কিরূপে?

 সুমুখে কে একজন দাঁড়াইয়াছিল, বসিয়া পড়িতেই অপূর্ব্বর কানের কাছে মুখ আনিয়া ভারতী চুপি চুপি কহিল, উনিই আমাদের প্রেসিডেণ্ট সুমিত্রা।

 বলিবার প্রয়োজন ছিল না। অপূর্ব্ব দেখিয়াই চিনিল। কারণ, নারীকে দিয়াই যদি কোন সমিতি পরিচালনা করিতে হয়, এই ত সেই বটে! বয়স বোধ করি ত্রিশের কাছে পৌঁছিয়াছে, কিন্তু যেন রাজ-রাণী! বর্ণ কাঁচা সোনার মত, দাক্ষিণাত্যের ধরণে এলো করিয়া মাথায় চুল বাঁধা, হাতে গাছ-কয়েক করিয়া সোনায় চুড়ি, ঘাড়ের কাছে সোনার হারের কিয়দংশ চিক্ চিক্ করিতেছে, কানে সবুজ পাথরের তৈরী দুলের উপর আলো পড়িয়া যেন সাপের চোখের মত জ্বলিতছে,—এই ত চাই! ললাট, চিবুক, নাক, চোখ, ভ্রূ, ওষ্ঠাধর,—কোখাও যেন আর খুঁত নাই—একি ভয়ানক আশ্চর্য্য রূপ! কালো বোর্ডের গায়ে একটা হাত রাখিয়া তিনি দাঁড়াইয়াছিলেন, অপূর্ব্বর চোখে আর পলক পড়িল না। সে আঁক কষিয়াই মানুষ হইয়াছে, কাব্যের সহিত পরিচয় তাহার অত্যন্ত বিরল, কিন্তু, কাব্য যাঁহারা লেখেন, কেন যে তাঁহারা এত কিছু থাকিতে তরুণ লতিকার সঙ্গেই নারীদেহের তুলনা করেন তাহার জানিবার কিছু আর রহিল না। সম্মুখে একটি বিশ-বাইশ বছরের সাধারণ গোছের মহিলা আনতমুখে বসিয়াছিলেন, ভাবে বোধ হয় তাঁহাকেই কেন্দ্র করিয়া এই তর্কের ঝড় উঠিয়াছে। আবার তাঁহারই অনতিদূরে রসিয়া প্রৌঢ় গোছের একজন ভদ্রলোক; তাঁহার পরনের কাটছাঁট পরিশুদ্ধ বিলাতি পোষাক দেখিয়া অবস্থাপন্ন বলিয়াই মনে হয়। খুব সম্ভব তিনিই প্রতিপক্ষ, কি বলিতেছিলেন অপূর্ব্ব ভাল শুনিতেও পায় নাই, মনোযোগও করে নাই, তাদের সমস্ত চিত্ত সুমিত্রার প্রতিই একেবারে একাগ্র হইয়া গিয়াছিল। তাঁহার কণ্ঠস্বরে কি জানি কোন পরম বিস্ময় ঝরিয়া পড়িবে এই ছিল তার আশা। অনতিকাল পূর্ব্বের ক্ষোভের হেতু তাঁহার মনেও ছিল না। সাহেবি পোষাক-পরা ভদ্রলোকটির প্রত্যুত্তরে

৯২