পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/১৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
১৫৮
পথের পাঁচালী

এক-একখানি করিয়া সে ধরে, শেষ না করিয়া আর ছড়িতে পারে না। চোখ টাটাইয়া ওঠে, রাগ টিপ টপ করে; পুকুরধারের নির্জন বাঁশবনের ছায়া ইতিমধ্যে কখন দীর্ঘ হইয়া মজা পুকুরটার পাটা-শ্যাওলার দামে নামিয়া আসে, তাহার খেয়ালই থাকে না কোন দিক দিয়া বেলা গেল!

কি গল্প! সরোজিনীকে সঙ্গে লইয়া সরোজ নৌকাযোগে মুর্শিদাবাদে যাইতেছেন, পথে নবাবের লোকে নৌক লুঠিয়া তাহাদের বন্দী করিল। নবাবের হুকুমে সরোজের হইয়া গেল প্ৰাণদণ্ড, সরোজিনীকে একটা অন্ধকার ঘরে চাবিতালা বন্ধ করিয়া রাখিয়া দিল। গভীর রাত্রে কক্ষের দরজা খুলিয়া গেল, নবাব মত্ত অবস্থায় কক্ষে প্রবেশ করিয়া বলিলেন-সুন্দরী, আমার হুকুম সরোজ মরিয়াছে, আর কেন.ইত্যাদি। সরোজিনী সদৰ্পে ঘাড় বাঁকাইয়া বলিলেন-রে পিশাচ, রাজপুত রমণীকে তুই এখনও চিনিস নাই, এ দেশে প্ৰাণ থাকিতে…ইত্যাদি। এমন সময় কাহার ভীম পদাঘাতে কারাগারের জানালা ভাঙিয়া গেল। নবাব চমকিয়া উঠিয়া দেখিলেন-একজন জটাজুটধারী তেজঃপুঞ্জকলেবর সন্ন্যাসী, সঙ্গে যমদূতের মতো বলিষ্ঠ চারি-পাঁচজন লোক। সন্ন্যাসী রোষকষায়িতনয়নে নবাবের দিকে চাহিয়া বলিলেন-নরাধম, রক্ষক হইয়া ভক্ষক? পরে সরোজিনীর দিকে চাহিয়া বলিলেন-মা, আমি তোমার স্বামীর গুরু-যোগানন্দ স্বামী, তোমার স্বামীর প্রাণহানি হয় নাই, আমার কমণ্ডলুর জলে পুনজীবন লাভ করিয়াছে, এখন তুমি চল মা আমার আশ্রমে, বৎস সরোজ তোমার অপেক্ষা করিয়া আছে।.গ্ৰন্থকারের লিপিকৌশল সুন্দর,-সরোজের এই বিস্ময়জনক পুনরুজীবন আরও বিশদভাবে ফুটাইবার জন্য তিনি পরবর্তী অধ্যায়ের প্রতি পাঠকের কৌতুহল উদ্দীপ্ত করিয়া বলিতেছেন-এইবার চল পাঠক, আমরা দেখি বধ্যভূমিতে সরোজের প্রাণদণ্ড হইবার পর কি উপায়ে তাহার পুনজীবন লাভ সম্ভব হইল…ইত্যাদি।

এক-একটি অধ্যায় শেষ করিয়া অপুর চোেখ ঝাপসা হইয়া আসে-গলায় কি যেন আটকাইয়া যায়। আকাশের দিকে চাহিয়া সে দুই-এক মিনিট কি ভাবে,–আনন্দে বিস্ময়ে, উত্তেজনায় তাহার দুই কান দিয়া যেন আগুন বাহির হইতে থাকে, পরে বুদ্ধনিঃশ্বাসে পরবতী অধ্যায়ে মন দেয়। সন্ধ্যা হইয়া যায়, চারিধারে ছায়া দীর্ঘ হইয়া আসে, মাথার উপর বাঁশঝাড়ে কত কী পাখির ডাক শুরু হয়, উঠিউঠি করিয়াও বইয়ের পাতার এক-ইঞ্চি ওপরে চোখ রাখিয়া পড়িতে থাকে-যতক্ষণ অক্ষর দেখা যায়।

এইরকম বই তো সে কখনও পড়ে নাই! কোথায় লাগে সীতার বনবাস আর ড়ুবালের গল্প? বাড়ি আসিলে তাঁহার মা বকে—এমন হাবলা ছেলেও তুই? পরের মাছ চৌকি দিস গিয়ে সেই একলা বনের মধ্যে বসে একখানা বই পড়বার লোভে? আচ্ছা বোকা পেয়েছে তোকে।

কিন্তু বোকা অপুর লাভ যেদিক দিয়া আসে, তাহার মায়ের সেদিক সম্বন্ধে কোন ধারণাই নাই। আজকাল সে দুইখানা বই পাইয়াছে ‘মহারাষ্ট্র জীবন-প্রভাত’ ও ‘রাজপুত জীবনসন্ধ্যা’। …উইঢিবি, বৈঁচিবনের প্রেক্ষাপটে নিস্তব্ধ দুপুরের মায়ায় দৃশ্যের পর দৃশ্য পরিবর্তিত হইয়া চলে-জেলেখা নদীর উপর বসিয়া আহত নরেনের শুশ্রুষা করিতেছে, আওরঙ্গজেবের দরবারে নিজেকে পাঁচহাজারী মনসবদারের মধ্যে