পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/১৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
পথের পাঁচালী
১৫৯

স্থান পাইতে দেখিয়া শিবাজী রাগে ফুলিয়া ভাবিতেছেন-শিবাজী পাঁচ-হাজারী? একবার পুনায় যাও তো, শিবাজীর ফৌজে কত পাঁচ-হাজারী মনসবদার আছে গনিয়া আসিবে!…

রাজবারার মরুপর্বতে, দিল্লি-আগ্রার রঙমহালে, শিশমহালে, ওড়না-পেশোয়াজ-পরা সুন্দরীদলের সঙ্গে তাহার সারা দিনমান কাটে। এ কোন জগৎ-যেখানে শুধু জ্যোৎস্না, তলোয়ারখেলা, সুন্দর মুখের বন্ধুত্ব, আহেরিয়া-উৎসবে দীর্ঘ বর্শা হাতে ঘোড়ায় চড়িয়া উষর উপত্যকা ও ভুট্টাক্ষেত্র পার হইয়া ছোটা?…

বীরের যাহা সাধ্য, রাজপুতের যাহা সাধ্য, মানুষের যাহা সাধ্য-প্রতাপসিংহ তাহা করিয়াছিলেন। হলদিঘাটের পার্বত্য বর্ক্সের প্রতি পাষাণ-ফলকে তাহার কাহিনী লেখা আছে। দেওয়ারের রণক্ষেত্রের দ্বাদশ সহস্র রাজপুতের হৃদয়রক্তে তাহার কাহিনী অক্ষয় মহিমায় লেখা আছে।

বহুদিন পরেও প্রাচীন যোদ্ধৃগণ শীতের রাত্রিতে অগ্নিকুণ্ডের পাৰ্থে বসিয়া পৌত্রপৌত্ৰিগণের নিকট হলদিঘাটের অদ্ভুত বীরত্বের কথা বলিত।…

অদৃশ্যহস্তনিক্ষিপ্ত একটি বর্শ আসিল।–অপু এই গ্রামের চিরশ্যাম বনভূমির ছায়ায়, লতাপাতার নিবিড়তায়, ভিজামাটির গন্ধে মানুষ হইয়াছে।–তবুও সে জানে রাজপুতানার ভীলপ্রদেশের বা আরাবল্পী-মেবারের প্রত্যেকটি স্থান, নাহারা মগরোর অপূর্ব বন্য সৌন্দর্য সে ভালো করিয়াই চেনে।. পর্বত হইতে অবতরণশীল শস্ত্ৰপাণি তেজসিংহের মূর্তি কি সুন্দর মনে হয়!…

“সেই চপ্পন প্রদেশে অনেকদিন অবধি সেই ভীল গ্রামের নির্জন কন্দরে ও উন্নত শিখরে রজনী দ্বিপ্রহরের সময় একটি রমণী-কণ্ঠ-নিঃসৃত গীত শ্রুত হইত। অতি প্ৰত্যুষে নির্জন প্রান্তরে, পথিকগণ কখনও কখনও একটি রমণীর পাণ্ডুর মুখ ও চঞ্চল-নয়ন দেখিতে পাইত; লোকে বলিত কোনো বিশ্রামশুন্যা উদ্বিগ্ন বনদেবী হইবে’…সেই গানের অস্পষ্ট করুণ মূৰ্ছনা যেন অপুর কানে বাঁশবাগানের পিছন হইতে ভাসিয়া আসে!…

কমলমীর, সূর্যগড়ের যুদ্ধ, সেনাপতি শাহবাজ খাঁ, সুন্দরী নুরজাহান, পুস্পকুমারী, বন্য ভীলপ্রদেশ, বীরবালক চন্দনসিংহ-দূর সুদূর কল্পনা।–তবুকত নিকট, কত বাস্তব মনে হয়। রাজবারার মরুভূমি আর নীল আরাবল্লীর উন্নত পর্বতের শিখরে শিখরে চেনার বৃক্ষে ফুল ফুটিয়া ঝরিয়া পড়িয়াছে, দেবী মিবার লক্ষ্মীর অলক্ত-রক্তপদচিহ্ন আঁকা রহিয়াছে বুনাস ও বরী নদীর তটভূমির শিলাখণ্ডে, ঝরনার উপলরাশির উপরে, বাজরা ও জওয়ার-ক্ষেতে ও মৌউল বনে।…

চিতোর রক্ষণ হইল না! রানা অমরসিংহ বাদশাহের সম্মান গ্রহণ করিলেন। সর্বহার পিতা প্রতাপসিংহ যিনি পঁচিশ বৎসর ধরিয়া বনে পর্বতে ভীলের পোল লইয়া যুদ্ধ করিয়াছিলেন, তিনি ব্যথাক্ষুব্ধচিত্তে কোথা হইতে দেখিয়াছিলেন এ সব?…

তপ্ত চোখের জলে পুকুর, উইঢিবি, বৈঁচিবন, বাঁশবাগান-সব ঝাপসা হইয়া আসে।