পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/১৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
১৬৬
পথের পাঁচালী

দু’চারিখানা কুড়ানো ঝিনুক বালি-কাদার রাশি হইতে ছাঁকিয়া নৌকার খোলে ছুড়িয়া ফেলিতেছে। অপু খুশির সহিত পটুকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল-দেখছিস পটু, কতক্ষণ ড়ুব দিয়ে থাকে? আয় গুনে দেখি এক-দুই করে! পারিস তুই অতক্ষণ ড়ুবে থাকতে?…

নদীর দুর্বাঘাস-মোড়া তীরটি ঢালু হইয়া জলের কিনারা পর্যন্ত নামিয়া গিয়াছে, এখানে-ওখানে বোঝাই নৌকায় খোটা পোঁতা-নোঙর ফেলা। ইহারা কত দেশ হইতে আসিয়াছে, কত বড় নদী খাল পার হইয়া, বড় বড় নোনা গাঙের জোয়ার-ভাটা-তুফান খাইয়া বেড়ায়,–অপুর ইচ্ছা করে মাঝিদের কাছে বসিয়া সে সব দেশের গল্প শোনে। তাহার কেবল নদীতে নদীতে সমুদ্রে সমুদ্রে বেড়াইতে ইচ্ছা হয়, আর কিছু সে চায় না। সুরেশের বইখানাতে নানা দেশের নাবিকদের কথা পড়িয়া অবধি ওই ইচ্ছাই তাহার মনে প্রবল হইয়া উঠিয়াছে! পটু ও সে নৌকার কাছে গিয়া দর করে-ও মাঝি, এই গোলপাতা একপাটি কি দর?…তোমার এই ধানের নৌকো কোথাকার, ও মাঝি?…ঝালকাঠির? সে কোন দিকে, এখান থেকে কতদূর?…

পটু বলিল-অপু-দা, চল তেঁতুলতলার ঘাটে একখানা ডিঙি দেখি, একটু বেড়িয়ে আসি চল। দুজনে তেঁতুলতলার ঘাট হইতে একখানা ছোট্ট ডিঙি খুলিয়া লইয়া, তাহাকে এক ঠেলা দিয়া ডিঙির উপর চড়িয়া বসিল। নদীজলের ঠাণ্ডা আদ্ৰ গন্ধ উঠিতেছে, কলমি-শাকের দামে জলপিপি বসিয়া আছে, চরের ধারে-ধারে চাষীরা পটলক্ষেত নিড়াইতেছে, কেহ ঘাস কাটিয়া আঁটি বাঁধিতেছে, চালতেপোতার বাঁকে তীরবতী ঘন ঝোপে গাঙশালিকের দল কলরব করিতেছে, পড়ন্ত বেলায় পুব আকাশের গায়ে নানা রঙের মেঘস্তুপ।

পটু বলিল-অপু-দা একটা গান কর না? সেই গানটা সেদিনের!

অপু বলিল–সেটা না। বাবার কাছে সুর শিখে নিয়েছি একটা খুব ভালো গানের। সেইটে গাইবো, আর-এাষ্ট্র ওদিকে গিয়ে কিন্তু ভাই, এখানে ডাঙায় ওই সব লোক রয়েচে—এখানে না।

–তুই ভারি লাজুক অপু-দা। কোথায় লোক রয়েচে কতদূরে, আবাঁ তোল গান গাইতে-দূৰ, ধরা সেইটো!

খানিকটা গিয়া অপু গান শুরু করে। পটু বাঁশের চটার বৈঠাখানা তুলিয়া লইয়া নৌকোর গলুইএ চুপ করিয়া বসিয়া একমনে শোনে; নৌকা বাহিবার আবশ্যক হয় না, স্রোতে আপনা- আপনি ভাসিয়া ডিঙিখানা ঘুরিতে ঘুরিতে লা-ভাঙার বড় বাঁকের দিকে চলে। অপুর গান শেষ হইলে পটু একটা গান ধরিল। অপু এবার বাহিতেছিল। নৌকা কম দূরে আসে নাই–লা-ভাঙার বাঁকটা নজরে পড়িতেছিল। এরই মধ্যে হঠাৎ পটু ঈশানকোণের দিকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বুলিল– ও অপু দা, কি রকম মেঘ উঠেচে দেখছিস! এখুনি ঝড় এলো বলে-নৌকা ফেরাবি?

অপু বলিল-হোকগে ঝড়, ঝড়েই তো নৌকা বাইতে–গান গাইতে লাগে ভালো, চল আরও যাই।