পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/১৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
পথের পাঁচালী
১৬৯

সেখানে অনেকদিন ছিল, সে দেশের সকলের সঙ্গে বাবার আলাপ ও বন্ধুত্ব, সকলে চেনে বা মানে। জিনিসপত্রও সস্তা। তাহার মা খুব আগ্রহ প্রকাশ করিল, সে সব সোনার দেশে কখনও কাহারও অভাব নাই–দুঃখ এ-দেশে বারোমাস লাগিয়াই আছে, সাহস করিয়া সেখানে যাইতে পারিলেই সব দুঃখ ঘুচিবে। মা আজ যাইতে পাইলে আজই যায়, একদিনও আর থাকিবার ইচ্ছা নাই। শেষে স্থির হইল বৈশাখ মাসের দিকে তাহদের যাওয়া হইবে।…

গঙ্গানন্দপুরের সিদ্ধেশ্বরী ঠাকুর-বাড়িতে সর্বজয়ার পূজা মানত ছিল। কোশ তিনেক দূরে কে পূজা দিতে যায়—এইজন্য এ-পর্যন্ত মানত শোধ হয় নাই। এবার এদেশ হইতে যাইবার পূর্বে পূজা দিয়া যাওয়া দরকার, কিন্তু খুঁজিয়া লোক মিলিল না। অপু বলিল-সে পূজা দিয়া আসিবে ও ওই গ্রামে তাহার পিসিমা থাকেন, তাহার সহিত কখনও দেখাশোনা হয় নাই, আমনি দেখা করিয়া আসিবে। তাহার মা বলিল-যাঃ, বকিস নে তুই, একলা যাবি বই কি? এখান থেকে প্রায় চার-ক্লোশ পথ।

অপু মায়ের সঙ্গে তর্ক শুরু করিল-আমি বুঝি সবদিন এইরকম বাড়িতে বসে থাকবো? যেতে পাববো না কোথাও বুঝি? আমার বুঝি চোখ নেই, কান নেই, পা নেই?

–সব আছে, উনি একলা যাবেন সেই গঙ্গানন্দপুর-বড় সাহসী পুরুষ কিনা!

অবশেষে কিন্তু অপুর নির্বন্ধতিশয্যে তাহাকেই পাঠাইতে হইল।

সোনাডাঙা মাঠের বুক চিরিয়া উঁচু মাটির পথ। পথের দু’ধারে মাঠের মধ্যে শুধুই আকন্দযুলের বন, দীর্ঘ শ্বেতাভ ডাটাগুলি ফুলের ভারে নত হইয়া দূৰ্বাঘাসের উপর লুটাইয়া পড়িয়াছে। পথে কোনো লোক নাই, দুপুরের অল্পই দেরি আছে, গাছপালার ছায়া ছোট হইয়া আসিতেছে। অপুর খালি পায়ে বেলেমাটির তাত লাগিতেছিল-তোহাতে বেশ আরাম হয়। পথের ধারের বন-ঝোপে কত কি ফুল ফুটিয়াছে, সাইবাবলা গাছের নতুন ফোটা ফুলের শিষ সূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া আছে, ছোট এক রকমের গাছে রাঙা রাঙা বনভুমুরের মতো কি ফল অজস্র পাকিয়া টুকটুক করিতেছে, মাটির মধ্য হইতে কেমন রোদপোড়া সোদা সোদা গন্ধ বাহির হইতেছে..সে মাঝে মাঝে নিচু হইয়া ঝোপের ভিতর হইতে খুঁজিয়া খুঁজিয়া বৈঁচিফল তুলিয়া হাতে-সেলাই-করা রাঙা সাটিনের জামাটার দু’পকেট ভর্তি করিয়া লইতেছিল।

যাইতে যাইতে তাহার মন পুলকে ভরিয়া উঠিতেছিল। সে কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে পারে না যে, সে কী ভালোবাসে এই মাটির তাজা রোদপোড়া গন্ধটা, এই ছায়াভিরা দূৰ্বাঘাস, সূর্যের আলোমাখানো মাঠ, পথ, গাছপালা, পাখি, বনঝোপ, ওই দোলানো ফুলফুলের থোলো, আলকুশি, বনকালমি, নীল অপরাজিতা। ঘরে থাকিতে তাহার মোটেই ইচ্ছা হয় না; ভারি মজা হয় যদি বাবা তাহাকে বলে-খোকা, তুমি শুধু পথে পথে বেড়িয়ে বেড়াও, তাহা হইলে এইরকম বনফুল-ঝুলানো ছায়াচ্ছন্ন ঝোপের তলা দিয়া ঘুঘু-ডাকা দূর বনের দিকে চোখ বাখিয়া এই রকম মাটির পথটি বাহিয়া শুধুই হ্যাঁটে—শুধুই হ্যাঁটে।…মাঝে মাঝে হয়তো বাঁশবনের কঞ্চির ডালে ডালে শরশিরা শব্দ, বৈকালের রোদে সোনার সিঁদুর ছড়ানো আর নানা রঙ-বেরঙ-এর পাখির গান।