সর্বজয়ার কিন্তু সেদিকে মন ছিল না। এই মাত্র তাহার মনে পড়িয়াছে; অনেকটা এই রকম চেহারার ও এইরকম বয়সের—সেই তাহার বুড়ি ঠাকুরঝি ইন্দির ঠাকরুন, সেই ছেড়া কাপড় গেরো দিয়া পরা, ভাঙা পাথরে আমড়া ভাতে ভাত, তুচ্ছ একটা নোনাফলের জন্য কত অপমান, কেউ পোঁছে মা, কেউ মানে না, দুপুর বেলায়, সেই বাড়ি হইতে বিদায় করিয়া দেওয়া, পথে পড়িয়া সেই দীন মৃত্যু…
সর্বজয়ার অশ্রু বাধা মানিল না।
মানুষের অন্তর-বেদনা মৃত্যুর পরপারে পৌঁছায় কিনা সর্বজয়া জানে না, তবু সে আজ বার বার মনে মনে ক্ষমা চাহিয়া অপরিণত বয়সের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করিতে চাহিল।
কয়েকদিন পরে অপু দালান দিয়া যাইতেছে, উপরের সিঁড়ি বাহিয়া মেজ বৌ-রানীর মেয়ে লীলা নামিতেছিল। তাহাকে দেখিতে পাইয়া বলিল—দাঁড়াও না? তোমার নাম কি-অপু না কি?
অপু বলিল-অপু বলে মা ডাকে—ভালো নাম শ্রীঅপূর্বকুমার রায়…
সে একটু অবাক হইল। এ বাড়ির ছেলেমেয়েরা কখনও ডাকিয়া তাহার সঙ্গে কথা কহে নাই। লীলা কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। কি সুন্দর মুখ। রানুদি, অতসীদি, অমলাদি, সকলেই দেখিতে ভালো বটে। কিন্তু তখন সে তাহাদের চেয়ে ভালো কাহাকেও দেখে নাই। এ বাড়ি আসিয়া পর্যন্ত তাহার পূর্বেকার ধারণা একেবারে বদলাইয়া গিয়াছে। বিশেষ করিয়া মেজ বৌ-রানীর মতো সুন্দর কোনো মেয়ে কল্পনাও সে করে নাই। লীলাও মায়ের মতো সুন্দরী-সেদিন যখন লীলা মেয়ের মজলিশে হাসির কবিতা বলিতেছিল, তখন অপু একদৃষ্টি তাহার মুখের দিকে চাহিয়া ছিল, কবিতা সে ভালো শোনে নাই।
লীলা বলিল-তোমরা কতদিন এসেচ আমাদের বাড়ি? সেবার এসে তো দেখিনি?
-আমরা ফাল্লুন মাসে এইচি, এই ফাল্লুন মাসে—
—কোথেকে এসেচ তোমরা?
—কাশী থেকে। আমার বাবা সেইখানেই মারা গেলেন কিনা-তাই—
অপুর যেন বিশ্বাস হইতেছিল না। সারা ঘটনাটা এখনও যেন অবাস্তব, অসম্ভব ঠেকিতেছিল। লীলা, মেজ বৌ-রানীর মেয়ে লীলা তাহাকে ডাকিয়া যাচিয়া তাহার সঙ্গে কথা কহিতেছে! খুশিতে তাহার সারা গা কেমন করিতে লাগিল!
লীলা বলিল-চলো, আমার পড়ার ঘরে গিয়ে বসি, মাস্টার মশায়ের আসবার সময় হয়েচে—এসো—
অপু জিজ্ঞাসা করিল-আমি যাবো?
লীলা হাসিয়া বলিল-বারে, বলচি তো চলো, তুমি তো ভারি লাজুক?—এসো-তুমি দেখোনি আমার পড়ার ঘর? ওই পশ্চিমের দালানের কোণে?…