পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পথের পাঁচালী
২৯

এতক্ষণ বাড়ি ছিল না, কোথা হইতে এইমাত্র আসিল। তাহার স্বর একটু সতর্কতা মিশ্রিত। মানুষের গলার আওয়াজ পাইয়া অপু কলের পুতুলের মতো লক্ষ্মীর চুপড়ির কড়িগুলি তাড়াতাড়ি লুকাইয়া ফেলিল। পরে বলিল—কি রে দিদি?

 দুর্গা হাত নাড়িয়া ডাকিল—আয় এদিকে—শোন—

 দুর্গার বয়স দশ এগারো বৎসর হইল। গড়ন পাতলা পাতলা, রং অপুর মতো অতটা ফরসা নয়, একটু চাপা। হাতে কাচের চুড়ি, পরনে ময়লা কাপড়, মাথার চুল রুক্ষ— বাতাসে উড়িতেছে, মুখের গড়ন মন্দ নয়, অপুর মতো চোখগুলি বেশ ডাগর ডাগর। অপু রোয়াক হইতে নামিয়া কাছে গেল, বলিল,—কি রে?

 দুর্গার হাতে একটা নারিকেলের মালা। সেটা সে নিচু করিয়া দেখাইল, কতকগুলি কচি আম কাটা। সুর নিচু করিয়া বলিল—মা ঘাট থেকে আসে নি তো?

 অপু ঘাড় নাড়িয়া বলিল—উঁহু—

 দুর্গা চুপি চুপি বলিল—একটু তেল আর একটু নুন নিয়ে আসতে পারিস? আমের কুশি জারাবো।—

 অপু আহ্লাদের সহিত বলিয়া উঠিল—কোথায় পেলি রে দিদি?

 দুর্গা বলিল—পট্‌লিদের বাগানে সিঁদুরকোটোর তলায় পড়ে ছিল—আন দিকি একটু নুন তার তেল?

 অপু দিদির দিকে চাহিয়া বলিল—তেলের ভাঁড় ছলে মা মারবে যে? আমার কাপড় যে বাসি?

 —তুই যা না শিগগির করে, মা’র আসতে এখন ঢের দেরি—ক্ষার কাচতে গিয়েচে— শিগগির যা—

 অপু বলিল—নারকোলের মালাটা আমায় দে। ওতে ঢেলে নিয়ে আসবো।—তুই খিড়কি দোরে গিয়ে দ্যাখ্ মা আসচে কিনা।

 দুর্গ নিম্নস্বরে বলিল—তেল টেল যেন মেঝেতে ঢালিসনে, সাবধানে নিবি, নইলে মা টের পেয়ে যাবে।—তুই তো একটা হাবা ছেলে—

 অপু বাড়ির মধ্য হইতে বাহির হইয়া আসিলে দুর্গা তাহার হাত হইতে মালা লইয়া আমগুলি বেশ করিয়া মাখিল,—বলিল, নে হাত পাত।

 —তুই অতগুলো খাবি দিদি?

 —অতগুলি বুঝি হল? এই তো—ভারি বেশি।—যা, আচ্ছা নে আর দু’খানা—বাঃ, দেখতে বেশ হয়েচে রে, একটা লঙ্কা আন্‌তে পারিস্? আর একখানা দেবো তাহলে—

 —লঙ্কা কি করে পাড়বো দিদি? মা যে তক্তার ওপর রেখে দ্যায়, আমি যে নাগাল পাইনে?

 —তবে থাক্‌গে যাক্—আবার ওবেলা আনবো এখন—পট্লিদের ডোবার ধারের আমগাছটায় গুটি যা ধরেচে—দুপুরের রোদে তলায় ঝরে পড়ে—

দুর্গাদের বাড়ির চারিদিকেই জঙ্গল। হরিহর রায়ের জ্ঞাতি-ভ্রাতা নীলমণি রায় সম্প্রতি গত বৎসর মারা গিয়াছেন, তাঁহার স্ত্রী পুত্রকন্যা লইয়া নিজ পিত্রালয়ে বাস করিতেছেন। কাজেই পাশের এ ভিটাও