পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
পথের পাঁচালী
পথের পাঁচালী

দুই ধারে বাঁশবন, সেখানে যাইয়া দেখিতে তাহার সাহসী হইল না। বকুলগাছের গুড়ির কাছে সরিয়া গিয়া সে দুই-একবার চিৎকার করিয়া ডাকিল-ভাটিশেওড়া বনে কি জন্তু তাহার গলার সাড়া পাইয়া খসি খসি শব্দ করিয়া ডোবার দিকে ছুটিয়া পলাইল।

বাড়ির পথে ফিরিতে ফিরিতে হঠাৎ সে থমকিয়া দাঁড়াইল। সামনে সেই গাব গাছটা! এক সন্ধ্যার পর এ গাবগাছের তলার পথ দিয়া যাওয়া! সর্বনাশ! গায়ে কাঁটা দিয়া ওঠে। কেন যে তাহার এই গাছটার নিচে দিয়া যাইতে ভয় করে, তাহা সে জানে না। কোন কারণ নাই, এমনিই ভয় করে এবং কারণ কিছু নাই বলিয়া ভয় অত্যন্ত বেশি করে। এত দেরি পর্যন্ত সে কোনো দিন বাড়ির বাহিরে থাকে নাই–আজ তাহার সে খেয়াল হইল না। মন ব্যস্ত ও অন্যমনস্ক না থাকিলে সে কখনই এপথে আসিত না।

অপু খানিকক্ষণ অন্ধকার গাবতলাটার দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া ফিরিল। তাহাদের বাড়ি যাইবার আর একটা পথ আছে–একটুখানি ঘুরিয়া পটলিদের বাড়ির উঠান দিয়া গেলে গাবতলার এ অজানা বিভীষিকার হাত হইতে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।

পাটলির ঠাকুরমা সন্ধ্যার সময় বাড়ির রোয়াকে ছেলেপিলেদের লইয়া হাওয়ায় বসিয়া গল্প করিতেছেন। পাটলির মা রান্নাঘরে রাঁধিতেছেন। উঠানের মাচাতলায় বিধু জেলেনি দাঁড়াইয়া মাছ বিক্রয়ের পয়সা তাগাদা করিতেছে।

অপু বলিল–দিদিকে খুঁজতে গিয়েছিলাম ঠাকুমা—বকুলতলা থেকে আসতে আসতে–

ঠাকুরমা বলিলেন–দুগগা এই তো বাড়ি গেল। এই কতক্ষণ যাচ্ছে–ছুটে যা দিকি– বোধ হয় এখনও বাড়ি গিয়ে পৌঁছয়নি–

সে এক দৌড়ে বাড়ির দিকে ছুটিল। পিছন হইতে পাটলির বোন রাজী চেচাইয়া বলিল–কাল সকালে আসিস অপু–আমরা গঙ্গা-যমুনা খেলার নতুন ঘর কেটেছি! টেকশালের পেছনে নিমতলায়–দুগগাকে বলিস–

তাহাদের বাড়ির কাছে আসিয়া পৌঁছিয়া হঠাৎ সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া গেল–দুৰ্গা আর্তস্বরে চিৎকার করিতে করিতে বাড়ির দরজা দিয়া দৌড়াইয়া বাহির হইতেছে–পিছনে পিছনে তাহার মা কি একটা হাতে মারিতে মারিতে তাড়া করিয়া ছুটিয়া আসিয়াছে। দুৰ্গা গাবতলার পথ দিয়া ছুটিয়া পলাইল, মা দরজা হইতে ধাবমানা মেয়ের পিছনে চেচাইয়া বলিল–যাও বেরোও–একেবারে জন্মের মতো যাও–আর কক্ষনো বাড়ি যেন ঢুকতে না হয়—বালাই, আপদ চুকে যাক-একেবারে ছাতিমতলায় দিয়ে আসি।

ছাতিমতলায় গ্রামের শ্মশান। অপুর সমস্ত শরীর যেন জমিয়া পাথরের মতো আড়ষ্ট ও ভারী হইয়া গেল। তাহার মা সবেমাত্র ভিতরের বাড়িতে ঢুকিয়া মাটির প্রদীপটা রোয়াকের ধার হইতে উঠাইয়া লইতেছে। সে পা টিপিয়া টিপিয়া বাড়ি ঢুকিতেই তাহার মা তাহার দিকে চাহিয়া বলিল–তুমি আবার এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলে শুনি? মোটে তো আজ ভাত খেয়েচো?

তাহার মনে নানা প্রশ্ন জাগিতেছিল। দিদি আবার মারা খাইল কেন? সে এতক্ষণ কোথায়