এই নৈরাশ্যের অবস্থা অতিক্রম করিয়া বৃন্দা আবার ছুটিল, যে-পর্য্যন্ত আশার লেশ আছে—সে পর্য্যন্ত সে চেষ্টা ছাড়িবে না। রাধার কাছে সে মুখ দেখাইবে কিরূপে? তাহাকে কি বলিয়া বুঝাইবে? আজ যে মানের দায়ে তাহার প্রাণ যাইতে বসিয়াছে।
হঠাৎ যমুনাকূলে কদম্ববৃক্ষমূলে তাহার দৃষ্টি পড়িল, সেখানে সে হারাণো রতন কুড়াইয়া পাইল। কৃষ্ণের অবস্থা দেখিয়া এই দুঃখের মধ্যেও বৃন্দার হাসি পাইল। একদিকে বাঁশীটি পড়িয়া আছে—এত সাধের বাঁশী—সুখ-দুঃখের সঙ্গী বাঁশী কৃষ্ণের হস্ত-চ্যূত; কৃষ্ণ ধূলায় ধূসর, অপর দিকে, ময়ুরপুচ্ছের কত গৌরবের চুড়াটি—তাহাও শির-চ্যুত, ধুলায় লুটাইতেছে। কৃষ্ণের কম্পিত ওষ্ঠ এই অবস্থায়ও “হা রাধে, হা রাধে” বলিতেছে, এত দুঃখেও কৃষ্ণ নাম ছাড়েন নাই, এ যুগে নাম সত্য,—সেই নাম ছাড়েন নাই। এদিকে তাঁহার হাতছাড়া বাঁশীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে পবন হিল্লোলিত হইতেছে, ‘রাধানামে সাধা বাঁশী’ তখন আপনা হইতেই “জয় রাধে শ্রীরাধে” বলিয়া বাজিয়া উঠিতেছে। কারণ বাঁশী আর কিছু জানে না। ওষ্ঠাধরের সেই অর্দ্ধস্ফুট রাধানাম ও বাঁশীর আকুল ‘রাধা রাধা’ ধ্বনি সেই নীপমূলে অদৃশ্য চিত্তহারী কল্পলোকের সৃষ্টি করিয়াছে। সেই কল্পলোকে উন্মত্তের ন্যায় পরিবেদনা বিমূঢ়, আর্ত্ত, ধূলিধূসর কৃষ্ণ পড়িয়া আছেন।
‘‘যমনুকূলে, নীপহি মূলে, লুট বনওয়ারী,
শশিশেখর ধুলিধূসর, কহত প্যারী প্যারী।’’
উপরে আমি এই পদটির যে বিবৃত্তি দিয়াছি, তাহার একটি কথাও আমার নিজের নহে, কীর্ত্তনীয়াদের আখর হইতে পাওয়া।