এই আশঙ্কায় কীর্ত্তনের আসরে গৌর-চন্দ্রিকার সৃষ্টি। গৌরচন্দ্রিকা দিক্দর্শনী স্বরূপ, বিশাল পদ-সমুদ্রে নাবিককে ঠিক্-পথ দেখাইয়া লইয়া যায়—দিক্ভ্রান্ত হইতে দেয় না। একঘণ্টা কাল মূলগায়েন ও দোহারগণ খোল পিটিয়া ও মন্দিরা-করতাল বাজাইয়া—শ্রোতারা আসরে কি প্রত্যাশা করেন—তাহারই একটা মুখবন্ধ প্রস্তুত করেন।
পূর্ব্বরাগের পালা আরম্ভ করিবার আগে গৌরবিষয়ক এরূপ কোন গান উচ্চকণ্ঠে গাহিতে থাকেন—
‘‘আজ হাম কি পেশিলু নবদ্বীপচন্দ্র,
করতলে করই বদন অবলম্ব।
পুনঃ পুনঃ গতায়ত করু ঘরপন্থ,
ক্ষণে ক্ষণে ফুলবনে চলই একান্ত।
ছল ছল নয়নে কমল সুবিলাস,
নব নব ভাব করত বিকাশ।
পুলক মুকুল বর ভরু সব দেহ,
এ রাধামোহন কছু ন পায়ল খেহ।”
চিত্রকর যেরূপ তুলির রং ঘষিয়া ঘষিয়া রূপরেখায় একটী স্থায়ী বর্ণ তৈয়ারী করেন, সেইরূপ পুনঃ পুনঃ এই গানটি গাহিতে গাহিতে শ্রোতার মনে ভাবমুগ্ধ গৌরাঙ্গের মূর্ত্তি স্থায়ীরূপে পরিকল্পিত হয়। গোরা আজ বড়চঞ্চল চিত্ত, একবার ঘরে একবার বাহিরে যাতায়াত করিতেছেন, তারপরে কি ভাবিয়া পুনরায় ফুলবনের দিকে একান্তে চলিয়া যাইতেছেন। তাঁহার সজল চক্ষুদুটিতে পদ্মের মত দৃষ্টি নূতন নূতন ভাবে খেলিয়া যাইতেছে। ক্ষণে ক্ষণে মনে আনন্দ উছিলিয়া উঠিতেছে এবং সর্ব্বশরীর রোমাঞ্চিত হইতেছে। এই ভাব কি—তাহা পদকর্ত্তা রাধামোহন ঠিক্ করিতে পারিতেছেন না।