পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০০
পদ্মানদীর মাঝি

হইবে? তা ছাড়া পাঁচকুড়ি টাকার মায়া ত্যাগ করিবার সাধ্য কুবেরের নাই। বিবাহ দিলে মেয়ে পরের ঘরে যায়, কাছে অথবা দূরে। গােপি না হয় যাইবে দূরে—অনেক দূরের ময়নাদ্বীপে। হয়তাে কখনও একটু মন কেমন করিবে কুবেরের। কিন্তু তার প্রতিকার কী? মন তাে অনেক কারণেই কেমন করে মানুষের।

 খবর শুনিয়া রাসু গালাগালি করিয়া গিয়াছে। বলিয়াছে, কথা দিয়া কথা রাখিল না কুবের, কুবেরের সে সর্বনাশ করিয়া ছাড়িবে। যুগীকে গিয়া রাসু বুঝি ধরিয়াছে, তারপর একদিন শীতল আসিয়া রাসুর স্বপক্ষে খানিকক্ষণ ওকালতি করিয়া গিয়াছে কুবেরের কাছে। বলিয়াছে, টাকা যদি বেশি চায় কুবের, সে তা বলে না কেন? সােনাখালির পাত্র যত টাকা দিতে চায় তাই দিবে রাসু। গ্রামে রাসুর মতাে পাত্র থাকিতে দূর দেশে মেয়েকে কুবের পাঠাইবে কেন?

 কেন? এ কেন-র জবাব দিবার ক্ষমতা নাই কুবেরের। ময়নাদ্বীপে গিয়া গােপিকে বাস করিতে হইবে ভাবিলে জালে আবদ্ধ ইলিশ মাছের মতাে মাঝে মাঝে তারও মনটা কি ছটফট করে না? তবু তাকে এসব বলা মিছে।

 একদিন গােয়ালন্দে অধরের সঙ্গে কুবেরের দেখা হইয়া গেল। অধর বলিল, কয়েকদিন আগে কপিলা চরডাঙায় আসিয়াছে, কিছুদিন থাকিবে। বাড়ি ফিরিয়া কুবের সেদিন মালাকে বড়াে দরদ দেখায়। বলে, মালা কতকাল বাপের বাড়ি যায় নাই, ইচ্ছা করে না যাইতে? ইচ্ছা যদি হয় তবে না হয় চলুক মালা কাল, দু-চার দিন থাকিয়া আসিবে। মালা বলে, না, বাপের বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা তাহার নাই। বাপ কি যাইতে বলিয়াছে তাকে? এতকাল সে যে যায় নাই, একবার কি দেখিতে আসিয়াছে তাকে? মালা কাঁদো কাঁদো হইয়া যায়। বলে, তার মনটা শুধু পােড়ায় বাপ ভাইয়ের কথা ভাবিয়া, তার জন্য ওদের কারও দরদ নাই। কেন সে যাইবে বাপের বাড়ি যাচিয়া? কুবের বিপন্ন হইয়া বলে, গেলে দোষই বা কী? বাপের বাড়ি তাে বটে, যাচিয়া বাপের বাড়ি যাইতে কারও লজ্জা নাই। কালই চলুক মালা, দুদিন একদিন পরেই ফিরিয়া আসিবে?

 এবার মালা সন্ধিগ্ধ হইয়া বলে, যাওনের লাইগা জিদ কর ক্যান মাঝি?

 জিদ কিবা? দরদ কইরা কইলাম, জিদ!

 মালার উপর রাগের সীমা থাকে না কুবেরের। চরভাঙা যাওয়ার আর তাে কোনাে ছুতা তাহার নাই! জামাই অকারণে শ্বশুরবাড়ি গেলে দোষ অবশ্য কিছুই হয় না কিন্তু এখন কপিলা ওখানে আছে, হঠাৎ কুবেরের আবির্ভার ঘটিলে কে জানে কে কী ভাবিয়া বসিবে। বসিয়া বসিয়া কুবের উপায় চিন্তা করে আর ক্রুদ্ধ চোখে মালার দিকে থাকিয়া থাকিয়া তাকায়। হ, আজ বসন্তের আদর্শ আবহাওয়া আসিয়াছে কেতুপুরে, দোলের উৎসব হইবে কাল, লখা ও চণ্ডী আবির কিনিয়া আনিয়া আজই অঙ্গনে খানিক ছড়াইয়াছে।

 বিকালে পদ্মার ঘাটে নৌকার তদবির করিতে গিয়া কুবেরের আরও মন কেমন করিতে থাকে। কাব্যের মসৃণ মার্জিত মন-কেমন করা নয়, তার ভীরু প্রকৃতির সঙ্গে যতখানি