কুবের খানিকক্ষণ নড়িল না। উদাসভাবে দাঁড়াইয়া রহিল। তারপর কাছে গিয়া বলিল, কী কন?
সে রাগ করিয়া বলিল, কী কন! কী কই জানস না? মাছ লইয়া আয়, তিনডা আনিস।
মাছ তাে নাই শেতলবাবু।
নাই কী রে, নাই? রােজ আমারে মাছ দেওনের কথা না তর? নিয়া আয় গা, যা। বড়াে দেইখা আনিস।
কুবের মাথা নাড়িল, আইজ পারুম না শেতলবাবু। আজান খুড়া সিদা মাের দিকে চাইয়া রইছে দেখ না? বাজারে কেনাে গা আইজ।
কিন্তু কুবের চুরি করিয়া যে দামে মাছ দেয় বাজারে কিনিতে গেলে তার তিনগুণ দাম পড়িবে। শীতল তাই হঠাৎ আশা ছাড়িতে পারিল না।
সে মিনতি করিয়া বলিল, তিনডা মাছ আইজ তুই দে কুবের। অমন করস ক্যান? পয়সা নয় কয়ডা বেশিই লইস, আঁই?
তালি খানিক খাড়াও শেতলবাবু।
কুবের ফিরিয়া গিয়া কাপড়টা ভালাে করিয়া গায়ে জড়াইয়া নৌকায় বসিল। চারিদিকে চেনা লােক কম নয়। চুপিচুপি মাছ লইয়া তাহাকে তীরে উঠিতে দেখিলে নিশ্চয়ই সন্দেহ করিবে। লজ্জার তাহার সীমা থাকিবে না। তবে একটা ভরসার কথা এই যে সকলেই নিরতিশয় ব্যস্ত। নিজের নৌকা হইতে কে কোথায় দুটা মাছ চুরি করিতেছে তাকাইয়া দেখিবার অবসর কাহারও নাই। চারিদিকে নজর রাখিয়া তিনটা মাছ কুবের একসময় গায়ের কাপড়ের তলে লুকাইয়া ফেলিল। তীরে উঠিয়া শীতলের হাতে দিতেই মাছ কটা সে চটের থলির মধ্যে পুরিয়া ফেলিল।
পয়সা কাইল দিমু কুবের।
বলিয়া সে চলিয়া যায়, কুবেরও সঙ্গে সঙ্গে পা বাড়াইয়া বলিল, রন শেতলবাবু, অমন ত্বরা কইরা যাইয়েন না। দামটা দ্যান দেখি।
কাইল দিমু কইলাম যে?
অঁই, অখন দ্যান। খামু না? পােলাগাে খাওয়ামু না?
পয়সা নাই তাে দিমু কী? কাল দিমু, নিয্যস দিমু।
পিছল নরম মাটিতে পায়ের বুড়া আঙুল গাঁথিয়া গাঁথিয়া শীতল চলিয়া গেল। আরক্ত চোখে তাহার দিকে চাহিয়া থাকিয়া অস্ফুটস্বরে কুবের বলিল, হালা ডাকাইত! বিড়বিড় করিয়া শীতলকে আরও কয়েকটা গাল দিয়া কুবের নৌকায় গিয়া গলুইয়ের দিকে গা এলইয়া শুইয়া পড়িল।
গণেশটা বােকা। মাছের দাম বুঝিয়া পাওয়ার সময় একটু চেষ্টা করিয়াই ধনঞ্জয় তাহাকে সরাইয়া দিতে পারিয়াছিল। একা একা দাম লইবার সুযােগ সে কোনােদিনই প্রায় পায় না। কুবের এই সময়টা জোঁকের মতাে তাহার সঙ্গে লাগিয়া থাকে। টাকা পাওয়া মাত্র সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভাগটা বুঝিয়া লয়।