পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪
পদ্মানদীর মাঝি

জানে। সমুদ্রগামী জলপ্রবাহের আজও মুহূর্তের বিরাম নাই। গতিশীল জলতলে পদ্মার মাটির বুক কেহ কোনােদিন দেখে নাই, চিরকাল গােপন হইয়া আছে।


জেলেপাড়া নদী হইতে বেশি দূরে নয়। তবু এইটুকু পথ চলিতেই কুবেরের কষ্ট হইতেছিল। নৌকায় সমস্ত পথটা আবােল-তাবােল বকিয়া গণেশ এতক্ষণে চুপ করিয়াছে। ধনঞ্জয় নৌকা হইতে নামে নাই। পাশের গ্রামে কুটুমবাড়িতে তাহার কী প্রয়ােজন ছিল। নৌকা লইয়া সে একাই সেখানে চলিয়া গিয়াছে।

 গণেশের বাড়িটাই পড়ে আগে। সে বাড়িতে ঢুকিল না। অসুস্থ কুবেরের সঙ্গে আগাইয়া চলিল।

 নকুল দাস ঘরের দাওয়ায় বসিয়া তামাক খাইতেছিল।কুবেরকে দেখিতে পাইয়া ডাকিয়া বলিল, অ কুবির শােন, শুইনা যা।

 গণেশ বলিল, কুবির জ্বরে বড়াে কাতর গাে।

 নকুল বলিল, জ্বর নাকি? তবে যা, বাড়িত্ যা। দ্যাখ গিয়া বাড়িতে কী কাণ্ড হইয়া আছে।

 এমন কথা শুনিয়া ব্যাপারটা না জানিয়া যাওয়া চলে না। কুবের উদ্‌বিগ্ন হইয়া বলিল, কীসের কাণ্ড নকুলদা?

 শ্যাষ রাইতে তর বউ খালাস হইছে কুবির।

 কুবের অবাক হইয়া বলিল, হ? নয় মাস পুইরা যে মাত্র কয়টা দিন গেছে নকুলদা। ইটা হইল কিবা?

 ক্যান? নয় মাসে খালাস হয় না?

 গণেশ জিজ্ঞাসা করিল, পুরুষ ছাওয়াল হইছে না?

 নকুল সায় দিয়া বলিল, হ। আমাগাের পাচী গেছিল, আইসা কয় কি কুবেরের ঘরে নি রাজপুত্তুর আইছে বাবা, ওই একরত্তি একখান পােলা, তার চাঁদপানা মুখের কথা কী কমু। রং হইছে গােরা।

 কুবেরের স্তিমিত চোখ দুটি উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। নকুল শয়তানি হাসি হাসিয়া পরিহাস করিয়া বলিল, তুই তাে দেখি কালাকুষ্ঠি কুবির, গােরাচাঁদ আইল কোয়ান থেইকা? ঘরে তাে থাকস না রাইতে, কিচ্ছু কওন যায় না বাপু।

 গণেশ রাগিয়া বলিল, বউ গােরা না নকুলদা?

 হ, বউ তাে গােরাই, হ?

 এর বাড়ির পিছন দিয়া ওর বাড়ির উঠান দিয়া কুবের ও গণেশ এবার একটু জোরে জোরে পা ফেলিয়াই বাড়ির দিকে আগাইয়া গেল। গণেশ ভারী খুশি। বারবার সে বলিতে লাগিল, পােলা হইব কই নাই কুবির? কই নাই ইবার তর পােলা না হইয়া যায় না?

 শেষে বিরক্ত হইয়া কুবের বলিল, চুপ যা গণেশ। পােলা দিয়া করুম কী? নিজেগাের খাওন জোটে না, পােলা!

 গণেশ ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল, তুই নি গােসা করস কুবির?