পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮
পদ্মানদীর মাঝি

 কুবের প্রকাণ্ড একটা হাই তুলিয়া বলিল, বয় গণশা, বয়। অ পিসি,আমারে আর গণশারে দুগা মুড়ি দিবা গাে? আ লাে গােপি, আমারে নি এক ঘটি জল দিবার পারস? ঘরে মুড়ি ছিল না। কদাচিৎ থাকে। পিসি চারটি চিড়া আর একটু গুড় দিয়া গেল। গুড় মুখে দিয়া শুকনাে চিড়া চিবাইতে চিবাইতে কুবের বলিল, খা গণশা। রথের বাদলা নামছে দেখছস?

 হ।

 চালায় ছন চাপান লাগে। রাইতের বাদলায় ঘরে জল পড়ছিল, দ্যাখ।

 গণেশ চাহিয়া দেখিল, জল পড়িয়া ঘরের একটা কোণ সত্যই ভাসিয়া গিয়াছে। জিহ্বা দিয়া সে একটা আপশােশের শব্দ করিল। বলিল, কোণ দিয়া পড়ছে তাই বাঁচান, না তাে জিনিসপত্তর সকল ভাইসা যাইত। চালায় চাপাইবি নাকি ছন আইজ? মেলায় গেলি তাে সময় পাবি না?

 কুবের মাথা নাড়িয়া বলিল, ছন কই? নাই তাে।

 ছিল যে ছন?

 গােপির মার বিছানায় পাইতা দিছি।

ব্যাপারটা বুঝিয়া গণেশ গম্ভীর মুখে সায় দিয়া বলিল, ভালা করছস। যা বাদলা!

 ধীরে ধীরে তাহারা চিড়া চিবাইতে লাগিল। গণেশ যে তাগিদ লইয়া আসিয়াছিল সে যেন তাহারা ভুলিয়া গিয়াছে। খাওয়া বন্ধ করিল গণেশ আগে। বাড়ি হইতে সে দুটি পান্তা খাইয়া আসিয়াছে, কুবের খাক। ঘটিটা উঁচু করিয়া মুখে ঢালিয়া সে জল খাইল। আরও দুটি চিড়া মুখে দিয়া বাকিগুলি কুবের দান করিয়া দিল তাহার বড়ােছেলেকে। বলিয়া না দিলে চিড়াগুলি সে একাই খাইতে পারে সন্দেহ করিয়া বলিল, চণ্ডীরে দুগা দিস লখ্যা, আঁই?

 লখা মাথা নাড়িয়া বলিল, উঁহুক। উয়ারে পিসি দিব।

 পিসির আর নাই। দে কইলাম লখ্যা!

 কুবেরের দুই ছেলেই উলঙ্গ। বর্ষার ভাপসা গুমােটে ঘামিয়া তাহাদের শীর্ণ দেহ চকচক করিতেছে। পিতৃদত্ত প্রসাদের ভাগ বাটোয়ারা লইয়া ঘরের কোণে দুজনের একটা ছােটোখাটো কলহ বাধিয়া গেল। কুবের আর চাহিয়াও দেখিল না। এ যে তাহার ঠিক উদাসীনতা তা বলা যায় না। মনে মনে তাহার একটা অস্পষ্ট উদ্দেশ্যই বুঝি আছে। শিক্ষা হােক। নিজের নিজের ভাগ বুঝিয়া লইতে শিখুক! দুদিন পরে জীবনযুদ্ধে সমস্ত জগতের সঙ্গে যখন তাহাদের লড়াই বাধিবে তখন মধ্যস্থতা করিতে আসিবে কে?

 ঘটিটা তুলিয়া লইয়া ঘরের সামনে সংকীর্ণ দাওয়ায় উবু হইয়া বসিয়া কুবের উঠানে কুলকুচা করিল। গণেশের মতাে ঘটি উঁচু করিয়া আলগােছে জল খাইয়া কলিকায় তামাক সাজিতে বসিল। পিসি দাওয়ার এক পাশে ইলিশ মাছের তেলে ইলিশ মাছ ভাজিতেছে। অন্য পাশে মালার আঁতুড়। নিচু দাওয়ার মাটি জল শুষিয়া শুষিয়া ওখানটা বাসের অযােগ্য করিয়া দিয়াছে, তবু ওইখানেই ভিজা স্যাঁতসেঁতে বিছানায় নবজাত শিশুকে লইয়া মালা দিবারাত্রি যাপন করিবে। উপায় কী? যে নােংরা মানুষের জন্মলাভের প্রক্রিয়া! বাড়িতে ঘর