পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৩১

 বুড়া পীতম মাঝি চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল, নকুল তখনও শয়তানি করিয়া বলিল, যুগীর না পােলা হইব কুবির?

 কুবের বলিল, কে জানে? মুটাইছে দেখলাম।

 কে জানে, কী আশ্চর্য ইহাদের উপভােগ্য রসিকতা। যুগী পীতম মাঝির মেয়ে, সম্প্রতি জেলেপাড়ারই একধারে একখানা ঘর বাঁধিয়া মেজোকর্তার মুহুরি শীতল ঘােষের সঙ্গে বাস করিতেছে। এত লােকের মাঝে পীতমের সামনেই তাহার মেয়ের সম্বন্ধে নকুল যেমন অনায়াসে রসিকতা করে, সকলে হাসাহাসি করিয়া তাহা উপভােগও করে বিনা বাধায় ও বিনা দ্বিধায়।

 পীতম রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলে, বাইর তুই আমার বাড়ির থেইকা নকুইলা, দূর হ!

 নকুল মুচকি হাসিয়া বলে, গােসা কর ক্যান মামা! জবাব দিবার পার না মাইঝা কর্তা কুবিররে এ খাতির করে ক্যান—তাই জিগাইয়া? কুবিরের পােলা কেমন ধলা হইছে জিগাও।

 কুবের মুষ্টি তুলিয়া বলে, মারুম কইলাম নকুইলা, মাইরা লাশ করুম তরে।

 মনে হয়, সভার চেহারা বদলাইয়া গিয়াছে। রাসু ও হােসেন মিয়াকে উপলক্ষ করিয়া সভায় যে চাপা অসন্তোষ ও প্রতিবাদের ভাব আসিয়াছিল প্রসঙ্গান্তরে এখন তাহা বিলীন হইয়া গিয়াছে। ও বিষয়ে আর কাহারও কিছু বলিবার বা ভাবিবার নাই। হােসেন মিয়া উঠিয়া দাঁড়ায়।

 বিয়ানে একবার বাড়িত্ যাইও রাসু বাই। পয়সাকড়ি পাইবা মালুম হয়, নিকাশ নিয়া খারিজ দিমু। ময়নাদ্বীপির জমিন না নিলি জঙ্গল কাটনের মজুরি দিই—খাওন পরন বাদ। কাইল খাইও। লালচে দাড়ির ফাঁকে হােসেন মিয়া মৃদু মৃদু হাসে, বলে, মন করতিছ, হােসেন মিয়া ঠক। তােমারে ঠকাইয়া হােসেন মিয়ার ফয়দা কিসির! কোন্ হালারে আমি জবরদস্তি ময়নাদ্বীপি নিছি? আপনা খুশিতে গেছিলা, ঝুট না কলি মানবা রাসু বাই। ফিরা আইবার মন ছিল, আমারে কতি পারলা না? একসাথ আইতাম?

 রাসু ঘাড় নীচু করিয়া থাকে। আমিনুদ্দি বলে, যান নাকি মিয়া?

 হ।

 শােনেন। আমি ময়নাদ্বীপি যামু না। কইয়া থুইলাম।

 হােসেন মিয়া তেমনি মৃদু মৃদু হাসে।

 তোমারে যাতি কই নাই আমিনুদ্দি। খুশ না হলি ক্যান যাবা?

 পাতলা পাঞ্জাবি ঘামে ভিজিয়া যাওয়ায় হােসেল মিয়ার বুকের নিবিড় লােমরাজি দেখা যাইতেছিল। সেইখানে হাত দিয়া সে আবার বলিল, জান দিয়া তােমাগাে দরদ করি, এ্যানে আইজ তােমরা ঘা দিলা, এই দিলের মদ্যি।—কুবের বাই, ঘর যাইবা নাকি?

কুবের সায় দিয়া উঠিয়া আসিল। দুজনে গােয়াল পার হইয়া নামিয়া গেল পথে। আকাশ নিবিড় মেঘে ঢাকিয়া গিয়াছে, দুর্ভেদ্য অন্ধকারে জেলেপাড়ার পথ পায়ের তলেও হইয়া