ভিন্ন অবস্থায় পড়িলে হয়তাে সে কয়েকটি গীতিকা রচনা করিত, তার মধ্যে দুটি-একটি মুখে মুখে প্রচার হইয়া স্থান পাইত শতাব্দীর সঞ্চিত গ্রাম্যগীতিকার অমর অলিখিত কাব্যে—মাঠেঘাটে, মশালের আলােয় আলােকিত উঠানে গীত হইয়া হইয়া ভণিতায় হােসেনের নাম দূর-দূরান্তরে ছড়াইয়া পড়িত, লােকে বলিত হােসেন ফকির, চল কেতুপুরে দেওয়ান ফকির হােসেন ছাহাবের দরগায় চেরাগ জ্বালি। হােসেন বুঝি কুবেরকে একেবারে ভুলিয়া যায়। অনেকদিন আগে, কুবেরের মতাে ছেঁড়া কাপড় পরিয়া আধপেটা খাইয়া জলে কাদায় সে যখন দিন কাটাইত, সকাল সন্ধ্যায় তখন মনে তাহার ভাসিয়া আসিত গানের চরণ। ফুটা চালার নীচে ময়লা চাটাইয়ের বিছানায় উদরে উপবাস লইয়া তেমনিভাবে কাল রাতটা কাটাইয়া আজ আবার হােসেনের মনে গান ভাসিয়া আসিতেছে।
কুবের, গাহান বাইন্ধবার পার?
আমি পারতাম না। আমাগাের যুগইলা পারে। মুখে মুখে ছড়া বাইন্ধ্যা দেয়।
আমি বাইন্ধবার পারি।
কন কী মিয়া বাই?
হােসেন এখন লাজুক। সে এদিক ওদিক তাকায়। ঘন ঘন দাড়িতে হাত বুলাইয়া কুবেরের কাছেই অপরাধীর মত হাসে। লােকটার আদি-অন্ত পাওয়া ভার।
তারপর হােসেন বলে, বাঁধুম, শুনবা?
কুবের বলে, কন মিয়া বাই, কন।
একটু চুপ করিয়া থাকিয়া হােসেন সুর করিয়া বলিতে আরম্ভ করে
আঁধার রাইতে আশমান জমিন ফারাক কইরা থােও
বােনধু, কত ঘুমাইবা।
বাঁয়ে বিবি ডাইনে পােলা আকাল ফসল রােও
মিয়া, কত ঘুমাইবা।
মানের পাতে রাইতের পানি হইল রুপার কুপি,
উঠ্যা দেখবা না।
আলা করেন ঘরের চালা কেডা চুপি চুপি,
দিশা রাখবা না।
তােমার লাইগা হাওর দিয়া বাইয়া চেরাগ-নাও
দিল-জাগানি আলেন যিনি, মিয়া,
চিরা-মেঘের বাদাম তুইলা বন্ধু কনে যাও?
জিগায় তারে খাঁচার চিড়িয়া।
নিদ্ ভাঙ্গে না, দিল জাগে না, বিবির বুকের শির,
পাড়ি দিবার সময় গেল, মাঝি তবু থির—
মাঝি কত ঘুমাইবা।
কুবের অভিভূত হইয়া বলিল, মুখে মুখে বানাইলেন মিয়া বাই?
খুশ হলি না পারি কী? হােসেন মিয়া আর দাঁড়াইল না। দুপুরবেলা ঘরের চালের জন্য