পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৬
পদ্মানদীর মাঝি

শণ আনিতে গিয়া কুবের শুনিল, সে বিদেশ গিয়াছে। কোথায় গিয়াছে কেহ জানে না। কিন্তু হােসেন মিয়ার কথা কখনও বেঠিক হয় না। কুবেরের জন্য শণ সে রাখিয়া গিয়াছে।

 গােপির বয়স এগারাে, কুবের মেয়ের বয়স এক বছর ভাঁড়ায় আর এক বছর হাতে রাখিয়া বলে, নয়। ন বছর বয়সে যে মেয়ের এগারাে বছরের বাড়, বিয়ের বাজারে তার দাম আছে। গণেশের শালা যুগল সম্প্রতি পাশের গ্রাম হইতে বােনের তত্ত্ব লইবার ছলে আসা যাওয়া শুরু করিয়াছে। সােজাসুজি কথা সে এখনও পাড়ে নাই, আলাপ আলােচনার মাঝখানে বাঁকা বাঁকা প্রশ্ন করিয়া কুবের কী রকম দর হাঁকিবে জানিবার চেষ্টা করিয়াছে। স্পষ্ট করিয়া কুবেরও এখন পর্যন্ত কিছু বলে নাই। কথা উঠিলে বহুক্ষণ ধরিয়া মেয়ের প্রশংসা কীর্তন করিয়া শুধু একটু আভাস দিয়াছে দুকুড়ি তিনকুড়ি টাকার। বুদ্ধি থাকে যুগল আন্দাজ করিয়া নিক। গণেশের আত্মীয় বলিয়া টাকার বিষয়ে কুবের তাহাকে খাতির করিবে না। যুগল সম্ভবত তাহা টের পাইয়াছে, তাই ইলিশ মাছের মরশুমটা শেষ হইবার প্রতীক্ষায় আছে। হাতে তখন কী রকম টাকা জমে দেখিয়া কথা পাড়িবে। কুবের বােঝে না কী! সকলের গােপন মতলব সে চোখের পলকে আঁচ করিয়া ফেলে।

 মানুষ মন্দ নয় যুগল। এতকাল অবস্থা খুব খারাপ ছিল, তাই বত্রিশ বছর বয়স অবধি বিবাহ করিতে পারে নাই; নিজের চেষ্টায় এখন সে অবস্থা ভালাে করিয়াছে। উন্নতির জন্য তাহার প্রশংসনীয় প্রয়াসের কথা কাহারও অবিদিত নয়। দুটি একটি করিয়া কতকাল ধরিয়া কত কষ্টে সে কিছু টাকা জমাইয়াছিল, তারপর গণেশের কাছে বােনের বিবাহ দিয়া পাইয়াছিল তেইশ টাকা! সকলে ভাবিয়াছিল, এবার যুগল বিবাহ করিবে, বিবাহের জন্য ছাড়া অত কষ্টে টাকা জমায় কে? কিন্তু যুগল করে নাই। সমস্ত জমানাে টাকা দিয়া একটা বড়াে নৌকা কিনিয়া সকলকে সে অবাক করিয়া দিয়াছিল। দুশাে টাকা সে নৌকার দাম, সুতরাং টাকা সে কম জমায় নাই। ইচ্ছা করিলে ওই টাকায় সে তিন-তিনটা বিবাহ করিতে পারিত। অন্তত একটা বিবাহ করিয়া বাকি টাকায় একটা ছােটোখাটো নৌকা কিনিতে কোনাে বাধাই ছিল না। তার বদলে উপার্জনের এই স্থায়ী উপায়ের জন্য সমস্ত পুঁজি ভাঙিয়া সে যে সুবুদ্ধি ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়াছিল তার তারিফ করিতেই হয়। দ্যাখাে, এক বছরে যুগলের ভাঙা ঘর নূতন হইয়াছে, শীর্ণ দেহে মাংস লাগিয়াছে, বিবাহের জন্য টাকাও সে আবার জমাইয়া ফেলিতে পারিয়াছে কিনা কে জানে! জাহাজঘাটে অত বড়ো নৌকার না চাহিতে ভাড়া হয়। রেলে ও জাহাজঘাটে আসিয়া কত মানুষ ও মাল কত গ্রামে যায়, এক একটি বাণিজ্য দ্রব্যের মরসুমের সময় কত মহাজন গ্রামে দাদন দেওয়া মাল সংগ্রহের জন্য চড়া দরে অসংখ্য নৌকা ভাড়া নেয়। আর শুধু ভাড়া তাে নয়। উপরি আয়ও কী কম! ধানের বােঝাই লইয়া একদিনের পথ পাড়ি দিবার সময় দশ-বিশ সের ধান নৌকার গােপন ফাঁকে ফোকরে লুকাইয়া ফেলিবার সুযােগ মেলে ঢের। কেবল ধান নয়, কলাই, মটর, হলুদ, লংকা প্রভৃতি কত কী জিনিস বছর ভরিয়া যুগল অমন কত আনিয়াছে। উন্নতি সে আরও করিবে। কারণ, অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে কোনাে বিষয়ে তাহার এতটুকু শিথিলতা