পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৩৭

আসে নাই। এখনও সে আগের মতােই কৃপণ। আকুরটাকুরের মাঝিসমাজে আজ সে একজন মাতব্বর লােক। একদিন সে-ই যে গ্রামের মােড়ল হইয়া দাঁড়াইবে কেই তাহাতে সন্দেহ করে না।

 মালার ইচ্ছা বিবাহটা তাড়াতাড়ি চুকিয়া যায় গােপির। এত বয়স হইল আর কতকাল বয়স ভাঁড়াইয়া মেয়েকে কুবের ঘরে রাখিবে? লােকে যে ইতিমধ্যেই নিন্দা আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। স্বামীকে মালা তাগিদ দিয়া বলে, আগাে, যুগইলা নি কিছু কয়? কুবের তাহাকে চোখ ঠারিয়া বলে, কয় না?

 কী কয়?

 তা শুইনা তর কাম কী? মাইয়ালােক চুপ মাইরা থাক। পােলা বিয়ানের লাইগা পিরথিমিতে আইছস, বিয়া পােলা যত পারস—রাও করস কে রে?

 মালা রাগে বইকি!

 গাও জ্বালাইনা কথা দেহি খইর পারা ফোটে, মায় নি মুখে মধু দিছিল আঁতুড়ে?

 গােসা-হইলে মারুম গােপির মা।

 মারবা নাকি? আগাে মার, মার—না যদি মার লখার মাথা খাইবা।

 কুবের ঝিমাইতে ঝিমাইতে নিদ্রাকাতর চোখে স্ত্রীর দিকে তাকায়। হ, ছেলে কোলে রােগা বউটিকে তাহার রাজরানির মতাে দেখাইতেছে বটে। কে জানে রাজরানি দেখিতে কেমন? ছেলেটাও যেন ফরসাই হইয়াছে মনে হয়, এমনি বয়সে লখা আর চণ্ডী যেমন তামাটে লাল রংঙের ছিল সেরকম নয়। আঁতুড়ে যতদিন ছিল কুবের বিশ্বাস করে নাই, এখন তাহার মনে সন্দেহ আসিয়াছে যে ছেলেটা সত্যসত্যই খুব ফরসা হইবে। মালার রং তো কালো নয়, তামাটে—মাঝে মাঝে তাহাকে বাবুদের বাড়ির মেয়েদের মতাে ফরসাই দেখিয়া বসে। জেলেপাড়ার কোনও স্ত্রীলােকের গায়ে এমন চামড়া নাই। একটা পা যদি ওর হাঁটুর কাছ হইতে দুমড়াইয়া বাঁকিয়া না যাইত, কুবেরের ঘরে ও পায়ের ধূলা ঝাড়িতেও আসিত না। কিন্তু মালার চেয়েও ছেলেটার রং যেন ঢের বেশি ফরসা হইয়াছে। আরও কিছু বড়াে হইলে বিবর্ণ হইয়া আসিয়া শেষ পর্যন্ত রং হয়তাে ওর মালার মতােই দাঁড়াইবে। তাই যেন দাঁড়ায়। কুবের তাই চায়। যতই সে শান্ত ও সুবিবেচক হােক, মাঝে মাঝে লােকের বিশ্রী ইঙ্গিতে গা জ্বালা করে বইকী, মালার দিকে চাহিয়া কখনও কখনও মনে ঘনাইয়া আসে বইকী একটা বিতৃষ্ণা মেশানাে ব্যথিত ক্রোধ। কুবেরের দৃষ্টি আরও ঘােলাটে হইয়া আসে। এখন, শ্রাবণের এই প্রথম সপ্তাহে আকাশে মেঘের এক মুহূর্তের বিশ্রাম নাই। পরপর কয় রাত্রি অবিরত জলে ভিজিয়া কুবের আবার জ্বর বােধ করিতেছে।

 অনেকক্ষণ নীরবে কাটিয়া গিয়াছে, তবু থামিয়া যাওয়া আলােচনাটা আবার আরম্ভ করিতে কোনােরকম ভূমিকার দরকার হয় না। এইমাত্র রাগারাগি হইয়া গিয়াছে? কে বলিল! কত শান্ত ও মােলায়েম কুবেরের গলার স্বর।

 স্পষ্ট কইরা যুগল কিছু কয় না গােপির মা।

 মালার গলাতেও এতটুকু ঝাঁঝ নাই।