পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৮
পদ্মানদীর মাঝি

 কয় না? ক্যান? গােপিরে নিব না?

 গণশা কয় নিব, যুগইলা কিছু কয় না। উদিন আমারে জিগায় খোঁড়ার মাইয়া নি খোঁড়া হয়।

 তুমি কী কইলা?

 আমি কইলাম, তুই বলদ যুগইলা, খোঁড়া নি ব্যারাম যে মার থাকলি মাইয়া পাইবাে? আমাগাের গােপির চলন পরীর পারা। জানাে নি গােপির মা, গণশা মােরে এক বিষম বিত্তান্ত কয়। নকুইলা গিয়া গিয়া যুগইলার নাকি মন ভাঙে, বাকা বাকা মাইয়ার খবর দিয়া আহে। যুগইলা য্যান দুই-দশটা মাইয়ার খবর না নিয়া গােপিরে নিব না সন্দ করি গােপির মা!

 বলিয়া কুবের যেন ঘুমাইয়া পড়ে। কিন্তু মালা তাহাকে চেনে। সে প্রত্যাশা করিয়া থাকে।

 জানাে নি গােপির মা আরেক বিত্তান্ত? রাসু গােপিরে নিব কয়।

 মালা বিস্মিত হয় না। শুধু বলে, চালচুলা নাই।

 সায় দিয়া কুবের বােধ হয় এবার সত্যই ঘুমাইয়া পড়ে। কারণ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়াও মালা আর তাহার কোনাে মন্তব্য শুনতে পায় না। বসিয়া বসিয়া ছেলেকে সে স্তন দেয়। রােয়াকের ওদিকে রান্নার জায়গায় বসিয়া পিসি গােপির মাথার উকুন বাছিতেছে, সারারাত উকুনের কামড়ে মেয়েটা মাথা চুলকাইয়া সারা হয়। লখা ও চণ্ডী হয় ডাংগুলি খেলিতে গিয়াছে, আর না হয় কোথাও বঁড়শি ফেলিয়া ধরিতেছে পুঁটিমাছ। যেখানেই ওরা থাক আর যাই করুক, জলে ভিজিয়া জ্বরে পড়িবে না, জলে ডুবিয়া মরিবেও না। সে ভয় মালার নাই। সে কেবল ভাবিয়া মরে, মারামারি করিয়া ছেলে দুটা কোনােদিন না খুন হইয়া আসে। পঙ্গু বলিয়া বাহিরের জগতের সঙ্গে মালার পরিচয় কম। কেতুপুরের দশমাইল উত্তরে চরডাঙা গ্রামের এমনই এক ভাঙা কুটিরে তার মায়ের এক বামুন ঠাকুরের নামে কানাকানি করা পাপের প্রমাণস্বরূপ এই ভাঙা পা-টি লইয়া সে জন্মিয়াছিল, বড়াে হইয়াছিল বাড়ির মধ্যে লাঠিতে ভর দিয়া খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে। বাড়ির অদূরে রাম গােয়ালার গােয়ালঘরের কাছে কদম গাছটি পর্যন্ত ছিল তাহার কষ্টকর গতিবিধির সীমা। পাড়ার ছেলেমেয়েরা ওই কদম গাছটির তলে খেলা করিত, আর করিত মারামারি। বড়াে ছেলেরা ছােটো ছােটো ছেলেমেয়েগুলিকে মারিয়া আর কিছু রাখিত না। অনেক সময় এইসব মারামারির শেষ ফলটা গড়াইত বয়স্কদের মধ্যে, পাড়ায় মহামারি কাণ্ড বাধিয়া যাইত। দূরে দাঁড়াইয়া চোখ বড়াে বড়াে করিয়া মালা মজা দেখিত, বড়ো ভয় করিত তাহার। অন্য ছেলে মার খাইলে সে কিছুই করিত না, কিন্তু যেদিন সকলে মিলিয়া তাহার ছােটো ভাই দুটিকে পিটাইতে আরম্ভ করিত সেদিন সে খুলিত মুখ—তাহার বাঁশির মতাে সরু গলা শােনা যাইত পাড়ার সর্বত্র, সকলে ছুটিয়া আসিত। তার আগেই মালাকে কিন্তু দিতে হইত ভ্রাতৃপ্রেমের মূল্য। ভাইয়ের বদলে ছেঁচা খাইত সে। একজন একটা ধাক্কা দিলেই সে মাটিতে পড়িয়া যাইত। তখন চার-পাঁচজন মিলিয়া ধরাধরি করিয়া তুলিয়া তাহাকে ফেলিয়া দিত রাম গােয়ালার গােয়ালঘরের পিছনে গােবরগাদায়।