পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪০
পদ্মানদীর মাঝি

 ইলিশের মরসুমে কুবের এসময় বাড়ি থাকে কদাচিৎ। যেদিন থাকে সেদিন বড়ােলােকের বাড়ির পােষা কুকুরের মতাে উদাস চোখে এসব সে চাহিয়া দেখে, স্নেহমমতার এইসব খাপছাড়া কাণ্ডকারখানা। দেখিতে দেখিতে সে হাই তােলে, বড়ােলােকের পােষা কুকুরের মতােই চাটাইয়ে একটা গড়ান দিয়া উঠিয়া বসে, মুখখানা করিয়া রাখে গম্ভীর। লখা ও চণ্ডীর মতাে মন দিয়া সেও যে রূপকথা শুনিতেছে মালার তাহা টের পাইতে বাকি থাকে না। ছেলেরা ঘুমাইয়া পড়িলেও সে তাই থামে না, হাত নাড়িয়া মুখভঙ্গি করিয়া রস দিয়া ঘুমন্ত ছেলেদের গল্প বলিতে থাকে। গল্প বলিতে সে ওস্তাদ। একই গল্প বারবার বলিয়া শ্রোতাদের সে সমান মুগ্ধ করিতে পারে। গােপি সরিতে সরিতে মার গা ঘেঁষিয়া আসে। পিসি ঠায় বসিয়া থাকে দুয়ারের কাছে। মালার গল্প শুনিতে আরও কে কে আসিয়া পড়িয়াছে দ্যাখাে। গণেশের বউ উলুপী, ছেলে মনাই আর মেয়ে কুকী। আর আসিয়াছে সিধুর তােতলা হাবা মেয়ে বগলী। কথা বলিয়া কেহ মালার রূপকথা বলায় বাধা দেয় না, চুপচাপ শুনিয়া যায়। গল্প বলার ফাঁকে ফাঁকে মালাই সকলের সঙ্গে আলাপ করে।

 আ লাে উলুপী, পাক করছিলি কী?

 আখায় দুগা বাইগন দিছিলাম। আর ইলশার ঝােল।

 কুকী! গায় কাপড় তুইলা বয় হারামজাদি! মাইয়া য্যান সং।

 বলিয়া আড়চোখে চাহিয়া কুবেরকে লজ্জা দিয়া মালা আবার রূপকথা বলিতে থাকে।


এবারে বর্ষায় আউশ ধানের ফসল নষ্ট হইয়া গিয়াছিল।

 পীতম মাঝির বাড়ির পিছনে তেঁতুলগাছটার গুঁড়ি পর্যন্ত কোনােবার জল আসে না, এবার আউশ ধান পাকিবার সময় হঠাৎ এত জল বাড়িয়া গেল যে গাছের গুঁড়িটা সপ্তাহকাল ডুবিয়া রহিল প্রায় তিন হাত জলের নীচে। এ জল আগে বাড়িলে ক্ষতি ছিল না, জলের সঙ্গে ধানের গাছও বাড়িয়া চলিত। কিন্তু ফসল পাকিবার সময় জলের সঙ্গে পাল্লা দিয়া ধানগাছ কেমন করিয়া বাড়িবে?

 বড়াে বর্ষা হইয়াছিল এবার। কেতুপুরের মাইল পাঁচেক দূরে চন্নার চর নামে পদ্মার একটা নিচু চর অর্ধেক জলে ডুবিয়া গিয়াছিল, অনেকে ভয় পাইয়া চলিয়া গিয়াছিল চর ছাড়িয়া। বহুকাল আগে খেয়ালি পদ্মা যে ভূমিখণ্ডের সৃষ্টি করিয়াছিল কে জানে সহসা সে আবার তাহা গ্রাস করিয়া ফেলিবে কিনা! ডাঙার গ্রামে বর্ষার জল ঘরে উঠিলেও পূর্ববঙ্গের লােক ভয় পায় না, সে জলের স্রোত নাই। কিন্তু পদ্মার বুকে ছােটোখাটো চরে যেসব গ্রাম, পদ্মার জল নাগাল পাইলে সেসব গ্রামের ঘর বাড়ি গােরু মানুষ কুটার মতাে ভাসাইয়া লইয়া যাইবে।

 কত গ্রাম যে এবার পাঁচ-সাত দিন জলের নীচে ডুবিয়া ছিল।