পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৪১

 মালার বাপের বাড়ির গ্রাম চরডাঙা নাকি তলাইয়া গিয়াছিল এক কোমর জলের নীচে।

 খবর পাইয়া মালা কাঁদিয়া অস্থির হইয়াছিল। বলিয়াছিল, আই গাে তােমার পাষাণ প্রাণ! আমার বাপ ভাই ডুইবা মরে, একবার নি খবর নিলা!

 গণেশকে সঙ্গে করিয়া কুবের একদিন খবর আনিতে গেল।

 খাল পুকুর মাঠ ঘাট তখন একাকার হইয়া গিয়াছে। দুমাস আগে যে খেতের আল দিয়া মানুষ চলাচল করিত, এখন সেখানে লগি থই পায় না। কোনাে গ্রাম ভাসিয়া আছে দ্বীপের মতাে, কোনাে গ্রামে মানুষের ঘরের ভিতরে একহাঁটু জল উঠিয়াছে, সকলে বাস করিতেছে মাচা বাঁধিয়া। যে পারিয়াছে গােরু বাছুরের জন্যও মাচা বাঁধিয়া দিয়াছে, যে পারে নাই তার বােবা অসহায় পশুগুলি ঠায় দাঁড়াইয়া আছে জলের মধ্যে। গাছের ডালে পাখিরা শুধু আছে সুখে, ভূচর মানুষ ও পশুর কষ্ট অবর্ণনীয়। এক বাড়িতে কান্না শুনিয়া কুবের উঠানে নৌকা লইয়া গেল, দাওয়ার খুঁটি ধরিয়া ঘরের মধ্যে চাহিয়া দেখিল বাঁশের খুঁটির উপর দুখানা তক্তপােশ একত্র করিয়া জিনিসপত্র-সহ গৃহস্থ সপরিবারে বাস করিতেছে, মাসখানেকের একটি শিশুকে বুকে করিয়া গৃহস্থের স্ত্রী কাঁদিয়া আকুল। কী হইয়াছে শিশুটির? নীচে পড়িয়া ডুবিয়া মরিয়া গিয়াছে কাল রাত্রে। কতটুকু জল মেঝেতে, এক হাতও হইবে না। ছেলেকে বুকে আঁকড়িয়া ধরিয়া জননী ঘুমাইয়াছিল, কখন কেমন করিয়া সে নীচে পড়িয়া গিয়াছিল কে জানে! এক মাসের শিশু নিজে তাে নড়িতে চড়িতে পারে না, সেই ভরসায় তক্তপােশের মাচার চারিদিকে বেড়া তাহারা দেয় নাই, দুদিকে স্বামী স্ত্রী শুইয়াছিল, মাঝখানে ছিল শিশু। ছেলেকে বুকে করিয়া ঘুমের ঘােরে জননী কি পাশ ফিরিয়াছিল? ঘুমের ঘােরে ধারে সরিয়া সেই কি সন্তানকে বিসর্জন দিয়াছিল সর্বনাশা বন্যার জলে?

 চরডাঙা পৌঁছিয়া দেখা গেল সমস্ত গ্রাম জলমগ্ন, কোথাও একহাত একটু শুকনাে জমি নাই। ঘরে ঘরে স্রোতহীন কর্দমাক্ত জলরাশি থমথম করিতেছে। কুবেরের শ্বশুরবাড়ির সকলে আশ্রয় লইয়াছে বড়াে ঘরের চালার তলে কাঠের ছােটো স্থায়ী মাচাটুকুতে।

 দুটি গােরু ও বাছুরের জন্য তিনটি সুপারিগাছের মধ্যে মােটা বাঁশের ত্রিকোণ মাচা বাঁধা হইয়াছে, বাড়ির পােষা কুকুরটিও স্থান পাইয়াছে সেখানে। মালার বুড়া বাপ বৈকুণ্ঠ মাচায় বসিয়া ভীত গােরু দুটিকে খড় দিতেছিল, ঘরের চালে বসিয়া বঁড়শি দিয়া মাছ ধরিতেছিল মালার বড়াে ভাই অধর, আর ঘরের ভিতরকার মাচায় উঠিবার মই হইতে এদিকে রান্নাঘরের চাল পর্যন্ত পাশাপাশি দুটি বাঁশ বাঁধিয়া ইহারা যে সাঁকো তৈয়ারি করিয়াছে তার উপরে পা ঝুলাইয়া বসিয়াছিল কয়েকটি উলঙ্গ ছেলেমেয়ে। কুবের আসিয়াছে শুনিয়া মালার ছােটো বােন কপিলা মই ধরিয়া নামিয়া আসিল। কুবেরের শাশুড়ি আর নামিল না, ঘরের মাচার উপর হইতেই কন্যা ও নাতিনাতনির কুশল জিজ্ঞাসা করিয়া বর্ষার দেবতাকে শাপান্ত করিতে করিতে বলিতে লাগিল যে এতখানি বয়স তাহার হইয়াছে, এমন প্রলয়ংকর কাণ্ড আর তাে সে দেখে নাই বাপের জন্মে! কুবের কি জানে কী সর্বনাশ তাহাদের হইয়া গিয়াছে, বাঁধিয়া-ছাঁদিয়া পাট পচাইতে দিয়াছিল, অর্ধেক পাট যে কোথায় ভাসিয়া গিয়াছে পাত্তা নাই। ভাসিয়া আর যাইবে কোথায়, কেউ চুরি করিয়াছে নিশ্চয়। হ, গরিব গৃহস্থ তাহারা, কত আশায়