পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৪৩

 কপিলা যাইবে? বেশ।

 কুবেরের শাশুড়ি বড়াে চেঁচায়। সে বলিল, তােমারে কমু কী কুবের, মাইয়ারে নিয়া জ্বইলা মরি—হ রে বাপ, কপিলার কথা কই—মালার লাইগা ভাবুম কেরে? সােনার জামাই তুমি, খোঁড়া মাইয়ারে আমার মাথায় কইরা থুইছ—এই পােড়াকপাইল্যার কথা কই, কই আমাগাে কপিলার কথা। অলক্ষ্মীর মরণ নাই!

 সে বড়াে দুঃখের কাহিনি। সুখে ঘরকন্না করিতেছিল কপিলা, কী যে শনি ভর করিল তাহার কপালে, শীতের গােড়ায় স্বামীর সঙ্গে কলহ করিয়া সে চলিয়া আসিল বাপের বাড়ি! রাগ করিয়া তাহার স্বামী শ্যামাদাস আবার বিবাহ করিয়াছে, কপিলাকে নেয় না।

 এ খবর কুবের জানিত না। সে সবিস্ময়ে বলিল, হ?

 তারপর কপিলাকে স্বামীর কাছে পাঠানাে হইয়াছিল—ফাল্গুন মাসে। শ্যামাদাস তাহাকে বাড়িতে উঠিতে দেয় নাই, খেদাইয়া দিয়াছে। মানুষ তাে সে নয়, পশু। তাই তাে কুবেরের সঙ্গে তুলনা করিয়া কপিলার মা দিনরাত্রি তাহাকে গাল দেয়।

 তাই বটে, পঙ্গু বলিয়া মালাকে সে কখনও অনাদর করে নাই সত্য, সেটা তবে এতখানি প্রশংসার ব্যাপার? মালার জন্য, তাহার দারিদ্র্যপূর্ণ সংসারের ওই অলস অকর্মণ্য রমণীটির জন্য, কুবের হঠাৎ নিবিড় স্নেহ অনুভব করে। সৎ গৃহস্থ ও সৎ স্বামী বলিয়া যে প্রশংসা তাহার মালার জননী গলার জোরে দিগ্‌দিগন্তে রটনা করে তাহা যেন মালারই কীর্তি।

 খাওয়া-দাওয়ার পর কপিলা ও তাহার ভাইবােনদের সঙ্গে করিয়া কুবের কেতুপুরের উদ্দেশে বাহির হইয়া পড়িল। কপিলা খুব সাজিয়াছে। চুলে চপচপে করিয়া দিয়াছে নারিকেল তেল, গায়ে হলুদ মাখিয়া করিয়াছে স্নান, পরিয়াছে তার বেগুনে রঙের শাড়িখানি। স্বামী ত্যাগ করিয়াছে বটে, বয়েস তাে তার কাঁচা। আহা, কুটুমবাড়ি যাওয়ার নামে মেয়েটা আহ্লাদে আটখানা হইয়া উঠিয়াছে।

 কেতুপুরে পৌঁছিতে বেলা কাবার হইয়া আসিল। মালা উতলা হইয়া প্রতীক্ষা করিতেছিল, কিছু পাট চুরি যাওয়া ছাড়া তাহার বাপ-ভাইয়ের আর কোনাে ক্ষতি হয় নাই শুনিয়া সে আশ্বস্ত হইল। মালা শুধু খোঁড়া হইয়া জন্মে নাই, আরও একটি পঙ্গুতা তাহার আছে; সে হাসিতে জানে না, জীবন তাহাকে অলস করিয়া বিষণ্ণ করিয়াছে। ভাইবোনদের কাছে পাইয়া কতকাল পরে যে মুখে তাহার বিষণ্ণতার ছায়ালেশহীন হাসি ফুটিল!

 এদিকে স্বস্তি রহিল না কুবেরের। তার মতাে গরিব কে আছে জগতে? এই যে এতগুলি মানুষ আসিল বাড়িতে, ইহাদের সে খাওয়াইবে কী? আউশের ফসল নষ্ট হওয়ায় এবার যে দেশে দুর্ভিক্ষ হইবে এখন হইতে তাহা টের পাওয়া যায়। জলমগ্না পৃথিবীতে আহার্যের মূল্য বাড়িয়াছে। ইলিশের মরশুম বলিয়া এখন যদি কোনােরকমে চলিয়া যায়, তারপর? দু-চার পয়সা জমাইবার আশা ঘুচিয়া গেল। অতিথি আসিয়াছে, অতিথি চলিয়া যাইবে, তারপর সপরিবারে উপবাস করিবে সে। তখন হাত পাতিলে বৈকুণ্ঠ একটি পয়সাও তাহাকে দিবে না।

 নিমন্ত্রণ করিয়া ওদের সে তবে আনিয়াছে কেন? তার দুঃখের দিনে যারা ফিরিয়া তাকায়