পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৬
পদ্মানদীর মাঝি

করে, গােপি হইলেই ভালাে হয়। কিন্তু কুবের এ প্রস্তাব কানেও তােলে না। কত টাকা দিয়াছে হােসেন মিয়া তাহাকে? হাজার না লাখ? আর কী আছে রাসুর—ঘর-দুয়ার, জীবিকার উপায়? তা ছাড়া গােপির পাত্র একরকম ঠিক হইয়াই আছে—গণেশের শালা যুগল। যুগলের মতাে পাত্র থাকিতে যার তার হাতে কুবের মেয়ে দিবে কেন?

 গােপিকে কিন্তু বড়ােই পছন্দ হইয়াছে রাসুর।

 ময়নাদ্বীপের গল্প করিবার ছলে সে কুবেরের বাড়ি আসে, আড়চোখে আড়চোখে সারাক্ষণ সে গােপির দিকে তাকায়, পরির মতাে সুন্দরী মনে হয় গােপিকে তাহার। ভাইকে কোলে করিয়া বাঁকা হইয়া কী তাহার দাঁড়ানাের ভঙ্গিমা! হ, রুখাে রুখাে লালচে বটে চুলগুলি গােপির, কপালটা একটু উঁচুই, থ্যাবড়ানাে নাকের নীচে উত্তোলিত ওষ্ঠে ঠেকিয়া নােলকটা তাহার দুলিতে পায় না, আর হ, বড়াে নােংরা গােপি। তবু তাে রাসু চোখ ফিরাইতে পারে না! তবু তাে তার মনে পড়ে না এমন অতুলনীয় রূপ সে কোথাও দেখিয়াছে! কী রং গােপির! কী মনােহর তাহার চলাফেরা, কী চাউনি!

 বয়স রাসুর বেশি হয় নাই, যুগলের চেয়েও তার বয়স কম। নূতন করিয়া সংসার পাতিয়া জীবনটা আবার গুছাইয়া লইবার সময় তাহার পার হইয়া যায় নাই। গােপিকে পাইলে আবার সে আরম্ভ করিতে পারে—বয়স্থা বাড়ন্ত মেয়ে গােপি, বিবাহের এক বছরের মধ্যে ও স্বামীর ঘর করিতে আসিবে, পাঁচ-ছ বছরের একটা মেয়েকে বিবাহ করিয়া তার বড়াে হইবার আশায় হাঁ করিয়া বসিয়া থাকিবার ধৈর্য রাসুর আর নাই। যাদের সে বিসর্জন দিয়া আসিয়াছে ময়নাদ্বীপে, তাড়াতাড়ি আবার তাদের ফিরিয়া পাওয়া চাই। একা একা বড়াে কষ্ট হইতেছে রাসুর। পীতম মাঝির সঙ্গে রাসুর কলহ হইয়া গিয়াছে। হােসেন মিয়ার দেওয়া টাকাটা বাগাইয়া লওয়ার জন্য পীতম মাঝি বড়ােই ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিল। রাসু তাই পৃথক হইয়া গিয়াছে। কে জানিত গ্রামের মধ্যে পীতমের মেয়ে যুগীই সর্বস্বান্ত পিসতুতাে ভাইটিকে এতখানি খাতির করবে। শীতলকে দিয়া বাবুদের বলিয়া নিজের ঘরের কাছে খানিকটা জমি যুগীই রাসুকে জোগাড় করিয়া দিয়াছে—রাসু একখানা ঘর তুলিয়াছে সেখানে।

 সেই ঘরে রাসু বাস করে একা, হয়তাে ধ্যান করে গােপির! বিকালে কেতুপুর গ্রামের মধ্যে সওদা আনিতে যাওয়ার সময় পথের নির্জনতম অংশে কোনােদিন গোপি রাসুকে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিতে পায়।

 রাসু বলে, কই যাও গােপি? সে একটু স্নেহ-ব্যঞ্জক হাসি হাসে। গাঁট হইতে বাহির করে একটি কাচ বসানাে পিতলের আংটি আর পুঁতির মালা, বলে, নিবা?

 গােপি খুশি হইয়া উপহার গ্রহণ করে। রাসুকে ভালই লাগে তাহার, রাসুর জন্য সে একটু দুঃখ বােধ করে। কোথায় সেই ময়নাদ্বীপ কে জানে, সকলকে রাসু সেখানে হারাইয়া আসিয়াছে, বড়াে কষ্ট পাইয়াছে সে জীবনে। তাছাড়া রাসুর কথাগুলি ভারী মিষ্টি, শুনিতে বড়াে ভালাে লাগে গােপির। আর কী খাতিরটা রাসু তাহাকে করে। কত যেন সে বড়াে হইয়াছে, এগারাে বছরের মেয়ে সে নয়।

 যুগীর সঙ্গে মাঝে মাঝে রাসু পরামর্শ করে, একটা কী উপায় ঠাওরানাে যায় না কুবেরকে