পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৪৯

কুটিরগুলিকে কে যেন আবর্জনার মতাে নাড়িয়া চাড়িয়া চারিদিকে ছড়াইয়া দিয়াছে। কোনাে ঘর কাত হইয়া পড়িয়াছে, কোনাে ঘরের চালা নাই, কোনাে চালার অর্ধেক খড় উড়িয়া গিয়া বাঁশ বাহির হইয়া পড়িয়াছে, উঠান ভরিয়া পথ জুড়িয়া জমিয়াছে গাছের ডালপালা। কুবেরের শােবার ঘরখানা পড়িয়া গিয়াছে, গােপি খুব আঘাত পাইয়াছে, কে জানে ডান পা-টি তাহার ভাঙিয়া গিয়াছে কিনা। চালা উড়িয়া দূরে গিয়া পড়িয়াছে পীতমের গােয়ালঘরের, হীরু আর সিধুর একখানা ঘরও দাঁড়াইয়া নাই, অনুকূলের তিনখানা ঘরের একটার চালা নাই, বাকি দুখানার চালায় নাই খড়। রাসুর ঘরখানা ছিল একেবারে ফাঁকায়, ভিটা আর দুটি খুঁটি ছাড়া ঘরের চিহ্নটুকুও দেখিতে পাওয়া যায় না। শীতলের বাড়ির চারিদিকে বড়াে বড়াে গাছ, তার একটা গাছ পড়িলে বাড়ি তাহার পিষিয়া যাইত, কিন্তু গাছের আশ্রয়েই ঘরগুলি তাহার বাঁচিয়া গিয়াছে। জেলেপাড়ায় আরও অনেকেরই ক্ষতি হইয়াছে অল্পবিস্তর। মুসলমান মাঝিদের মধ্যে ক্ষতি হইয়াছে আমিনুদ্দির বেশি। প্রকাণ্ড একটা সিঁদুরে আমের গাছ গােড়াসুদ্ধ উপড়াইয়া যে ঘরে আমিনুদ্দির বউ আর ছেলেমেয়ে তিনটি ছিল সেই ঘরখানাকে মাটির সঙ্গে মিশাইয়া দিয়াছে। আমিনুদ্দির বউ থেঁতলাইয়া মরিয়াছিল সঙ্গে সঙ্গে, সকালে টানিয়া বাহির করার সময় ছেলেটার প্রাণ ছিল, ঘণ্টাখানেক পরে সে-ও শেষ হইয়া গিয়াছে। শুধু মেয়েটার কিছু হয় নাই। আমিনুদ্দি কোথায় আছে কে জানে, হয়তাে ডাঙায় নয়তাে পদ্মার উত্তাল জল-তলে, অত বড়াে মেয়েটা তাহার কারাে সান্ত্বনা মানিতেছে না, হাউহাউ করিয়া লুটাইয়া লুটাইয়া কাঁদিতেছে। যে মেয়ের পর্দা রাখিবার জন্য গরিব আমিনুদ্দি কুটির ঘেরিয়া উঁচু বেড়া দিয়াছিল, আজ যার খুশি তাকে দেখিয়া যাও। কালাে চোখে কাল সে যে কাজল দিয়াছিল এখনও তা ধুইয়া যায় নাই—বেড়ার ফাঁকে ওর কাজল চোখের সলাজ চাহনি দেখিয়া কাল অপরাহ্নে জহরের জোয়ান ছেলে নাসির বুঝি খুশি হইয়া পদ্মায় নৌকা ভাসাইয়াছিল, পদ্মা হয়তাে তাকে এতক্ষণ ধুইয়া মুছিয়া ফেলিয়াছে পৃথিবীর বুক হইতে।

 ভীত বিবর্ণ মুখে কাঁপিতে কাঁপিতে জেলেপাড়ার নরনারী পদ্মাতীরে গিয়া দাঁড়ায়, আরক্ত চোখে চাহিয়া থাকে উন্মত্ত জলরাশির দিকে। ঘাটে তিনটি নৌকা বাঁধা ছিল, একটি অদৃশ্য হইয়াছে, দুটি উঠিয়া আসিয়াছে ডাঙায়। খানিক দূরে গাছপালা সমেত খানিকটা ডাঙা ধ্বসিয়া গিয়াছে, আরও খানিকটা অংশ ফাটল ধরিয়া আছে, শীঘ্রই ধ্বসিবে।

 পদ্মাতীরে দাঁড়াইয়া থাকিয়া কোনাে লাভ নাই, চাহিয়া চাহিয়া চোখ ফাটিয়া গেলেও কাল যারা নদীতে পাড়ি দিয়াছিল তাদের দেখিতে পাওয়া যাইবে না। যে নদীতে ডুবিয়াছে সে তাে গিয়াছেই, ডাঙায় যারা আশ্রয় পাইয়াছে পদ্মা শান্ত না হইলে তাদেরও ফিরিয়া আসা সম্ভব নয়।

 ডাঙা-পথে আসিতে পারে।

 কিন্তু এখনও মাঠে ঘাটে জল একেবারে সরিয়া যায় নাই, কে কোথায় ডাঙা পাইয়াছে কে জানে, হয়তাে সেখান হইতে ডাঙায় পায়ে হাঁটিয়া আসিবার সুবিধা নাই। গৃহের জন্য