পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫০
পদ্মানদীর মাঝি

মন হয়তো তাহাদের উতলা হইয়াছে, ভােরের আলাে ফুটিলে এই উন্মাদিনী নদীর তীর ঘেঁষিয়া নৌকা বাহিয়া হয়তাে তাহারা গ্রামে ফিরিবার চেষ্টা করিবে।

 বেলা বাড়িয়া উঠিলে ধীরে ধীরে বাতাস পড়িয়া গেল। পদ্মা শান্ত হইয়া আসিল। অপরাহ্নে একটি দুটি করিয়া জেলেপাড়ার নৌকাগুলি ফিরিয়া আসিতে লাগিল। প্রথমে যারা আসিয়া পড়িল, সকলে তাদের ঘিরিয়া জুড়িয়া দিল কলরব।—বাকি সব? অন্য সকলের খবর কী? সকলের খবর তাহারা দিতে পারিল না, কে কোথায় তীরে ভিড়িয়াছে কে জানে, দু-চারজনের খবর মাত্র তাহারা বলিতে পারিল। যাদের সংবাদ জানা গেল তাদের উদ্‌বিগ্ন আত্মীয়স্বজনের মুখ হইতে একটা কালাে পর্দা যেন সরিয়া গেল। খবর যাদের মিলিল না তাদের আপনজনেরা আবার নীরবে পদ্মার সীমাহীন বুকে দৃষ্টি পাতিয়া রাখিল। তবে প্রত্যেকটি নৌকাই এই একটি আশার বারতা বহিয়া আনিতে লাগিল যে কারও প্রাণহানি হইয়াছে এ সংবাদ তাহারা শুনিয়া আসে নাই। বুক বাঁধিয়া সকলেই প্রতীক্ষা করিতে পারে, হয়তাে ব্যর্থ হইবে না।

 আমিনুদ্দি ও নাসির একসঙ্গেই ফিরিয়া আসিল। আমিনুদ্দির জন্য কেহ ঘাটে আসে নাই। জহর আসিয়াছিল, নাসিরকে দেখিয়া সে শুধু বলিল, বাপজান, ফির‍্যা আলি রে?—বলিয়া আমিনুদ্দির দিকে চাহিয়া একেবারে চুপ করিয়া গেল। কারাে মুখে কথা নাই। আমিনুদ্দিকে দেখিয়া সকলে স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে।

 আমিনুদ্দি এদিক ওদিক চাহিল, তারপর ভীত উৎসুক কণ্ঠে জহরকে জিজ্ঞাসা করিল, খপর কও মিয়াবাই, ভালা নি আছে বেবাকে? চুপ মাইরা রইলা কেরে, আঁই?

 কারাে কিছু বলিবার ছিল না। হাত ধরিয়া জহর তাহাকে ধীরে ধীরে গ্রামের দিকে টানিয়া লইয়া গেল।

 তারপর আসিল কুবের ও গণেশ। আসিল তাহারা অনুকূলের নৌকায়, ধনঞ্জয়ের নৌকাটি ডুবিয়া গিয়াছে। বােকা গণেশের একটা পা মচকাইয়া গিয়াছিল, ঝড়ে নয়, পা পিছলাইয়া একটা সে আছাড় খাইয়াছিল ডাঙায়। উলুপী আজ সারাদিন একরকম পদ্মাতীরেই কাটাইয়াছে, গণেশকে ধরিয়া সে-ই বাড়ি লইয়া গেল। কুবেরের জন্য কেহ আসে নাই। পরের মুখে সে তাহার গৃহের বৃত্তান্ত শুনিল। বড়াে ঘরটা পড়িয়া গিয়াছে? যে ঘর ছাইবার জন্য হোসেন মিয়া শণ দিয়াছিল? গােপির পায়ে চোট লাগিয়াছে? বিবর্ণ মুখে কুবের বাড়ির দিকে পা বাড়াইল। ঘর দুয়ার অনেকেরই পড়িয়াছে, সর্বনাশ হইয়া গিয়াছে আমিনুদ্দির, কিন্তু তাহার নিজের ঘরখানা পড়িয়া যাওয়ার চেয়ে বড়াে দুঃসংবাদ কুবেরের কাছে আর কিছুই নয়। কবে আবার সে ঘর তুলিতে পারিবে কে জানে। মাথা গুঁজিবে কোথায়?

 পথে দেখা হইল কপিলার সঙ্গে। কুবেরকে দেখিয়াই কপিলা উচ্চস্বরে কাঁদিয়া উঠিল—বড়াে উচ্ছ্বাস কপিলার। বলিল, ফিরা আইছ মাঝি? মুখ রাখছেন—ঠাহুর আমার মুখ রাখছেন—আমি না মানত কইরা থুইছি পাঁচ পহার হরিলুট দিমু!

 কুবের বিব্রত হইয়া বলিল, কাঁদ ক্যান?

 সঙ্গে চলিতে চলিতে কপিলা আত্মসংবরণ করিল॥