পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৫৩

পড়িয়াছে কুবের। মালার মতাে গােপিও কি শেষ পর্যন্ত খোঁড়া হইয়া যাইবে? কী ব্যবস্থা করা দরকার কুবের বুঝিয়া উঠিতে পারে না। হােসেন মিয়ার কথামতাে সদরের হাসপাতালে লইয়া যাইবে নাকি? সে তাে কম হাঙ্গামার ব্যাপার নয়! অতখানি পথ গােপিকে কেমন করিয়া লইয়া যাইবে? ব্যথায় সে বিছানাতেই পাশ ফিরিতে পারে না, অত নাড়াচাড়া তাহার সহিবে কেন? অথচ পায়ের যা অবস্থা গােপির, শীঘ্রই কোনাে ব্যবস্থা না করিলে নয়।

 ইতিমধ্যে পূজা আসিয়া পড়িল। চরডাঙা হইতে একদিন আবার আবির্ভাব ঘটিল অধরের। আবার সে রাগারাগি করিয়া সকলকে লইয়া যাইতে চাহিল। ছেলেমেয়েগুলি তাহার সঙ্গে ফিরিয়া গেল চরডাঙায়, কপিলা গেল না। বলিল, কেন, ঘর পড়িয়া গিয়া ঢেঁকিঘরটাতে যখন তাহারা সকলে একসঙ্গে মাথা গুঁজিয়া ছিল, অসুবিধার অন্ত ছিল না, তখন অধর আসিতে পারে নাই? এখন নতুন ঘর উঠিয়াছে, থাকিবার কোনাে অসুবিধা নাই, এখন সে যাইবে কেন এদের এই বিপদের মধ্যে ফেলিয়া? কুবেরও ইহাতে সায় দিয়া বলিল, হ, কেন যাইবে কপিলা তাদের এই বিপদের সময়? কপিলা সত্যই প্রাণ দিয়া সকলের সেবা করিতেছিল, বড়াে কৃতজ্ঞ হইয়া উঠিয়াছিল কুবেরও তাহার কাছে। বড়াে ভালাে মেয়ে কপিলা। কেন যে ওর বােকা স্বামীটা ওকে ত্যাগ করিয়াছে!


কেতুপুরে চারদিন পূজার ঢাক-ঢােল বাজিল-উৎসব হইল। জেলেপাড়ার ছেলেবুড়াে দুবেলা ঠাকুর দেখিল, কেহ কেহ তাড়ি গিলিয়া খুব মাতলামি করিল, শীতল একদিন একটা দেশি মদের বোতল সাবাড় করিয়া রাসুকে ধরিয়া আচ্ছা করিয়া পিটাইয়া দিল। রাসুর উপর তার এত রাগ কেন কে জানে!

 লখার সঙ্গে কপিলা একদিন সন্ধ্যার সময় ঠাকুর দেখিতে গিয়াছে, খানিক পরে কুবেরও গুটিগুটি গিয়া হাজির। গিয়া দেখে শীতলের সঙ্গে হাসিয়া হাসিয়া কথা বলিতেছে কপিলা। বাবুদের কর্মচারী শীতল, পূজাও বাবুদেরই—ভাবখানা দেখ শীতলের, সে-ই যেন সর্বেসর্বা এখানে! ওর সঙ্গে হাসিয়া হাসিয়া এত কথা কিসের কপিলার? তারপর শীতল প্রসাদ চাহিয়া আনিয়া কপিলার আঁচলে বাঁধিয়া দেয়, কপিলা একগাল হাসে। এত লােকের মধ্যে কপিলার এই নির্লজ্জ আচরণে রাগে কুবেরের নিশ্বাস বন্ধ হইয়া আসে। সে ডাকিয়া বলে, লখ্যা! ল বাড়িত্ যাই।

 কপিলা বলে, মাঝি আইছ নাকি? খাড়াও মাঝি, যামু আমি, মারে পেন্নাম কইরা লই।

 কুবের বলে, লখ্যা, আইলি রে হারামজাদা পােলা?

 কপিলা প্রণাম শেষ করিতে করিতে লখাকে সঙ্গে করিয়া কুবের জোরে জোরে হাঁটিতে আরম্ভ করিল। একটু পথ গিয়াই গতি তাহার হইয়া আসিল মন্থর। না, কপিলার জন্য ফিরিয়া সে যাইবে না, তবে আস্তে আস্তে হাঁটিতে দোষ নাই। কপিলা আসিয়া সঙ্গ নেয় তাে নিক। অন্ধকার হইয়া গিয়াছে। কপিলাকে একা ফেলিয়া যাওয়া ঠিক কর্তব্য হইবে না। হয়তাে শীতলকেই সে বাড়ি পৌঁছাইয়া দিতে বলিবে। এতখানি অন্ধকার রাস্তা