পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৪
পদ্মানদীর মাঝি

শীতলের সঙ্গে হাঁটিয়া চলিবে কপিলা? তার চেয়ে বিড়ি কিনিবার ছলে এখানে কুবেরের একটু দাঁড়ানােই ভালাে।

 বিড়ি কিনিতে কিনিতে কপিলা আসিয়া পড়িল। কুবের কথাটি বলিল না। তিনজনে নীরবে চলিতে লাগিল বাড়ির দিকে। কপিলা আড়চোখে কুবেরের মুখের দিকে তাকায়, কিছু ঠাহর হয় না অন্ধকারে। চলিতে চলিতে দেখা হয় রাসুর সঙ্গে, যুগীকে লইয়া সে ঠাকুর দেখিতে যাইতেছে।

 কপিলা যুগীকে বলে, বইন, এক কাম করবা? আমাগাে লখারে লইয়া যাও।

 কুবের আপত্তি করিয়া বলে, ক্যান, ঠাকুর দ্যাখে নাই লখা?

 কপিলা বলিল, পােলাপান, সাধ নি মেটে দেইখা? তােমার লখা বুড়া তাে হয় নাই মাঝি, একনজর দেইখা ফাল দিয়া বাড়িত্ ফিরবাে? যা রে লখা যুগী মাসির লগে—দেইখাে বইন পােলারে, পােলা বড়াে বজ্জাত।

 মতলব কী কপিলার? লখাকে সরাইয়া দিল কেন? কিছুই যেন বুঝিতে পারা যায় না। কপিলা নীরবে পথ চলে, কুবের মনে মনে রাগিতে থাকে। শেষে একটা তেঁতুল গাছের তলে, পথের যেখানে দুর্ভেদ্য অন্ধকার রচিত হইয়াছে সেখানে হঠাৎ কুবের শক্ত করিয়া কপিলার আঁচল চাপিয়া ধরে, বলে, শীতলের লগে অত কথা কিসের তর, আঁই?

 কপিলা বলে, কী কর মাঝি? খুইলা পড়ব যে পেরসাদ? আঁচলটা কপিলা টানিয়া ছাড়াইতে চেষ্টা করে, মিনতি করিয়া বলে, পােলাপানের লাখান কইরাে না মাঝি, ছাড়—রাস্তার মদ্যি ইডা কেমনতর কাণ্ড জুড়লা?

 বলিতে বলিতে আর কপিলা আঁচল টানাটানি করে না, কুবের তাহাকে জড়াইয়া ধরিলে শান্ত হইয়া থাকে, হঠাৎ বড়াে যেন করুণ কণ্ঠে বলে, মন ভালাে না মাঝি, ছাড়বা না? মনডা কাতর বড়াে।

 কুবের তাহাকে ছাড়িয়া দেয়।

 চলিতে চলিতে জিজ্ঞাসা করে, মন কাতর ক্যান রে কপিলা?

 কে জানিত কপিলা এমন উত্তর দিবে!

 সােয়ামিরে মনে পড়ে মাঝি।

 হ? আগাগােড়া সব তাহা হইলে ফাঁকি কপিলার, সব ছল, রসিকতা করিতেছিল কুবেরের সঙ্গে! ভালাে, কুবেরও রসিকতা জানে।

 কপিলার গালটা সে টিপিয়া দেয়, হি হি করিয়া হাষ্ট্রে বলে, তাই ক কপিলা, তাই ক! যে সােয়ামি দূর কইরা খেদাইয়া দিছে তার লাইগা মনডা পােড়ায় তর! গেলেই পারস সােয়ামির ঘর?

 যামু।

 বলিয়া কপিলা হনহন করিয়া হাঁটিতে আরম্ভ করে।