পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৬
পদ্মানদীর মাঝি

 নৌকা খােলা হইবে এমন সময় দেখা গেল রাসু ছুটিয়া আসিতেছে। নদীতীরে পৌছিয়া সে লাফাইয়া নৌকায় উঠিয়া পড়িল।

 কুবের জিজ্ঞাসা করিল, কীরে রাসু?

 রাসু হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, আমিও যামু।

 চলুক! এতবড়াে নৌকা, স্থানাভাব হইবে না। বেশি লােক সঙ্গে থাকিলে গােপিকে উঠানাে নামানাের বরং সুবিধাই হইবে।

 মহকুমা শহর আমিনবাড়ি, সেইখানে সরকারি হাসপাতাল। কেতুপুর হইতে আমিনবাড়ি বেশি দূর নয়, ঘণ্টা তিনেক লাগিল পৌঁছিতে। রাসুর সাধ ছিল গােপিকে ঘাট হইতে হাসপাতাল পর্যন্ত লইয়া যাইতে সেও কাঁধ দিবে, কিন্তু তার প্রয়ােজন হইল না। সকলকে নৌকায় বসিয়া থাকিতে বলিয়া যুগল নামিয়া গেল, খানিক পরে কোথা হইতে খুঁজিয়া পাতিয়া লইয়া আসিল একটা পালকি। যুগল কি কম পাকা লােক। পালকি চাপিয়া গােপি হাসপাতালে গেল।

 হাসপাতালে তখন রােগীর ভিড় জমিয়াছে। একটা ছােটো ছেলের ফোড়া অপারেশন করা হইতেছিল, কী তাহার তীব্র চীৎকার। গােপি তাে দেখিয়া শুনিয়া বিবর্ণ হইয়া গােঙাইতে আরম্ভ করিল। কুবেরের মুখখানাও শুকাইয়া পাংশু হইয়া গিয়াছে। সকলেই অল্পবিস্তর ভীত ও সন্ত্রস্ত। শুধু অবিচলিত আছে রাসু। ময়নাদ্বীপ হইতে পলাইয়া আসিয়া নোয়াখালির হাসপাতালে সে পনেরােটা দিন কাটাইয়া দিয়াছিল, এ তাহার পরিচিত স্থান। সকলকে সে অভয় দিয়া বলিতে লাগিল, ভয় নাই, ভয় নাই, সব ঠিক হইয়া যাইবে।

 সে-ই গিয়া ডাক্তারকে গােপির অবস্থা বলিয়া নামধাম লিখাইয়া আসিল। কী গর্ব রাসুর! দেখুক কুবের, কেমন চটপটে পাকা লােক সে! দেখিয়া রাখুক!

 বেলা প্রায় এগারােটার সময় অবসর করিয়া ডাক্তারবাবু গােপির পা পরীক্ষা করিলেন। পরীক্ষা করিয়া রাগের সীমা রহিল না ডাক্তারের। রাসুই কিনা বুক ঠুকিয়া কথা বলিতেছিল, তাহাকেই গােপির অভিভাবক ঠাওরাইয়া ধমক দিয়া ডাক্তার আর কিছু রাখিলেন না। এতকাল কী করিতেছিল তাহারা, বসিয়া বসিয়া ঘাস কাটিতেছিল? আগে আনিতে পারে নাই গােপিকে? পা যদি এবার কাটিয়া বাদ দিতে হয়?

 অপারেশন টেবিলে শুইয়া গােপি কপিলার হাত শক্ত করিয়া ধরিয়াছিল, গােঙাইয়া গােঙাইয়া সে তাে কাঁদিতে থাকেই, কপিলাও মৃদু সুর তােলে কান্নার—তারপর ডাক্তারের ধমকে আচমকা স্তব্ধ হইয়া যায়। পরীক্ষা শেষ করিয়া ডাক্তার বড়াে ভয়ানক কথা বলিলেন। এখানে রাখিয়া যাইতে হইবে গােপিকে। তবে একথাও তিনি বলিলেন যে, রাখা না-রাখা গােপির বাপের খুশি, জোরজবরদস্তি নাই।

 হাসপাতালের বারান্দায় পরামর্শ সভা বসিল। ডাক্তারের ধমকে রাসু বড়াে দমিয়া গিয়াছিল, সে আর কথা বলিল না—হয়তাে এতক্ষণে গােপির অবস্থার গুরুত্ব বুঝিয়া মনটাও তার খারাপ হইয়া গিয়া থাকিতে পাবে। ঘরের মধ্যে গােপি কাঁদিতে লাগিল—আগাে মাসি আমি থাকুম না, আমারে নিয়া যাও—আর বাহিরে কুবের গণেশ আর যুগল গভীর মুখে