পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৬
পদ্মানদীর মাঝি

 কী উপায় হইবে গােপির? রাসু মাঝে মাঝে আসে, বেশ বুঝিতে পারা যায়, গােপির অবস্থা দেখিয়া সে বড়ােই দুঃখিত হইয়াছে। গােপির হাঁটুর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ডাক্তার কী বলিয়াছে রাসু খুঁটাইয়া খুঁটাইয়া জিজ্ঞাসা করে, এক একদিন টিপিয়া টুপিয়া নিজেই পরীক্ষা করিয়া দেখিতে যায়, কী সন্তর্পণে সে যে স্পর্শ করে গােপির হাঁটু!

 মালা হঠাৎ রাসুকে বড়াে খাতির করিতে আরম্ভ করিয়াছে। যুগল অবস্থাপন্ন লােক, গােপির দিকে সে আর ফিরিয়াও চাহিবে না, চালচুলাহীন রাসু হয়তাে গােপিকে গ্রহণ করিতে পারে।

 বড়াে দোটানায় পড়িয়াছে রাসু। আজ সে চাহিলেই গােপিকে পায়, এক পয়সা পণও তাহাকে দিতে হইবে না—কিন্তু সে কি এই গােপিকে চাহিয়াছিল, এই পঙ্গু মেয়েটাকে? খোঁড়া মালাকে লইয়া কুবের সংসার পাতিয়াছে, অসুখী কুবের নয়, দারিদ্র‍্যের পীড়নে সে কষ্ট পায় বটে কিন্তু পরিবারিক জীবনটি তাহার কামনা করিবার মতাে—গােপিকে লইয়া হয়তাে সে এমনি সুখের সংসারই পাতিয়া বসিতে পারিবে। তবু মনটা খুঁতখুঁত করে রাসুর। খোঁড়া বউ। হয়তাে জীবনে কোনােদিন সে উঠিয়া দাঁড়াইতে পারিবে না—যদি পারেও, লাঠি ধরিয়া খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া হাঁটিবে, পায়ের পঙ্গুত্বের জন্য দেহের হয়তাে তাহার পুষ্টি হইবে না, চিরকাল কুৎসিত দেখাইবে তাহাকে।

 শেষ পর্যন্ত গােপির পায়ের অবস্থাটা কী দাঁড়ায় দেখিয়া কর্তব্য নির্ণয় করার জন্য প্রতীক্ষা করাও বিপজ্জনক। হাসপাতালের ডাক্তার যদি পা-টিকে ঠিক আগের মতাে করিয়া দেয়? মরা মানুষ বাঁচায় ডাক্তার, কত ওষুধ, কত যন্ত্রপাতি ডাক্তারের, একটা ভাঙা পা ঠিক করিয়া দেওয়া তার পক্ষে কঠিন নয়। তখন রাসুকে কি কুবের জামাই করিতে চাহিবে? আপশোশ করিয়া মরিতে হইবে রাসুকে তখন।

 সাইরা যাইব কয় নাই ডাকতর? রাসু জিজ্ঞাসা করে।

 হ। কুবের জবাব দেয়।

 কিন্তু একথা রাসু বিশ্বাস করিতে পারে না। গােপির পা যে কিছুদিনের মধ্যে ঠিক হইয়া যাইবে রাসুকে তাহা বিশ্বাস করাইতে এত বেশি আগ্রহ দেখায় কুবের যে রাসু সন্দিগ্ধ হইয়া ওঠে।

 হঠাৎ একদিন সে করে কী, চলিয়া যায় আমিনবাড়ি। হাসপাতালে গিয়া জিজ্ঞাসাবাদ করে, বলে যে সে গােপির আত্মীয়—কোনোমতেই কি গােপির পা-টি আগের মতাে করিয়া দেওয়া যায় না? ডাক্তারের সামনে হাতজোড় করিয়া সে দাঁড়াইয়া থাকে। কত ব্যাকুল, কত উৎকণ্ঠিত আত্মীয় সে গােপির!

 না, গােপির দরদী আত্মীয়কে ভরসা ডাক্তার দিতে পারেন না।

 রাসু চিন্তিত মুখে গ্রামে ফিরিয়া আসে। আবার সে দেখিতে যায় গােপিকে। শীতের কুয়াশার মতাে ফ্যাকাশে হইয়া গিয়াছে মেয়েটা, শীর্ণ রােগা মুখখানাতে জ্বলজ্বল করিতেছে