পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৬৯

 খানিক পরে আমিনুদ্দি উঠিয়া গেল। তখন হােসেন কুবের ও গণেশকে বুঝাইবার চেষ্টা করিল, ময়নাদ্বীপে গিয়া মঙ্গলই হইবে আমিনুদ্দির, এখানে শােকে দুঃখে কাতর হইয়া থাকিবে লােকটা, তার চেয়ে সেখানে গিয়া আবার বিবাহাদি করিয়া ঘর-সংসার করা কি ভালাে হইবে না ওর পক্ষে? ময়নাদ্বীপ কি সেরকম আছে এখন, জঙ্গল সাফ হইয়া এখন সেখানে নগর বসিয়াছে।

 হােসেন মিয়া চলিয়া গেলে গণেশ ও কুবের বসিয়া বসিয়া অনেকক্ষণ গল্প করিল। ভবিষ্যতের সব জল্পনা কল্পনা। চাকরি পাইয়া দুজনেই খুশি হইয়াছে, দেনাপাওনার ব্যাপারে হােসেন মিয়া কৃপণ নয়, কোথায় কোথায় যাইতে হইবে, লগি ঠেলা ছাড়া আর কী তাদের দিয়া হােসেন মিয়া করাইয়া লইবে, এখন তাই শুধু তাদের ভাবনা।


কয়েকদিন পরে হােসেন মিয়ার আহ্বান আসিল।

 কুবের ও গণেশ সকাল সকাল খাইয়া নদীর ঘাটে গেল। ঘাটে হােসেন মিয়ার বড়াে একটি পানসি বাঁধা ছিল। নৌকায় আরও দুজন মাঝি আছে, তারাও হিন্দু। হােসেন মিয়ার ব্যবস্থা ভালাে, একই নৌকায় হিন্দু-মুসলমান মাঝি থাকিলে তাহাদের রান্না-খাওয়ার অসুবিধা হয়, সে তাই তার তিনটি নৌকার দুটিতে শুধু মুসলমান মাঝিই রাখিয়াছে আর এই নৌকাটিতে রাখিয়াছে হিন্দু মাঝি। অন্য মাঝি দুজনের নাম শম্ভু ও বগা।

 তখন নদীতে কিছু কিছু কুয়াশা ছিল। সকলকে দাঁড় ধরিতে বলিয়া হােসেন নিজে হাল ধরিয়া বসিল। নৌকা চলিল দেবীগঞ্জের দিকে। দেবীগঞ্জে হােসেন নামিয়া গেল। ঘণ্টা খানেক পরে ফিরিয়া আসিয়া কুবেরকে সে ডাকিল কাছে। বলিল, কলিকাতা হইতে বিড়ি চালান আসিয়াছে, নৌকায় আমিনবাড়ি পৌঁছিয়া দিতে হইবে। সেখানে গিরিধারী সাহার গদিতে খবর দিলে তাহারা মাল নামাইয়া লইয়া যাইবে, তারপর কুবের নৌকা লইয়া ফিরিয়া আসিবে কেতুপুরে। দ্বিতীয় আদেশ পাওয়া পর্যন্ত নৌকা কেতুপুরে বাঁধা থাকিবে।

 সকলকে সঙ্গে করিয়া হােসেন রেলের মালগুদামে গেল। টাকা দিয়া মাল খালাস করিয়া আর সে কথা বলিল না, কুবেরের হাতে তিনটি টাকা দিয়া জেটিতে যে স্টিমারটি বাঁধা ছিল সােজাসুজি তাহাতে গিয়া উঠিল।

 হােসেন মুখে বলিয়া যায় নাই, তবু কাহারও বুঝিতে বাকি থাকে নাই যে সমস্ত ভার সে দিয়া গিয়াছে কুবেরকে, কুবেরই সব ব্যবস্থা করিবে। কুবের প্রথমটা একেবারে অভিভূত হইয়া গেল। এ কী সম্মান তার, এ কী সৌভাগ্য! এতবড়াে একটা নৌকা, তিনজন জবরদস্ত মাঝি, তিনশ চারশ টাকার মাল—এ সমস্তর উপর কর্তৃত্বের অধিকার তাহার একার। সকলের রাহাখরচের টাকা পর্যন্ত হােসেন মিয়া তাহার জিম্মা করিয়া দিয়া গিয়াছে।

 মাল তুলিতে বলিতে গিয়া কুবেরের মুখে কথা আটকাইয়া গেল। ভয়ে ভয়ে সে একবার সকলের মুখের দিকে চাহিল। হােসেন মিয়ার পক্ষপাতিত্বে না জানি মনে মনে ওরা কত রাগিয়াছে!