পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৭৫

পারিবে না। শুধু সাহসের অভাবে নয়, দু আনার বেলায় যে বিবেক তাহার চুপ করিয়া থাকে পাঁচ টাকার বেলায় তাহাই গর্জন করিয়া উঠিবে।

 টাকাগুলি কোমরে বাঁধিয়া কুবের লখা ও চণ্ডীর দিকে চাহিল। তারপর দুটা পয়সা সে ছুঁড়িয়া দিল ছেলেদের দিকে। পয়সা দুটা কুড়াইয়া নিয়া দুজনে চোখের পলকে অদৃশ্য হইয়া গেল।

 এমন সময়ে দেখা গেল আলুথালু বেশে একটি মেয়ে ঘাটের দিকে ছুটিয়া আসিতেছে। নৌকার উপর আমিনুদ্দি চঞ্চল হইয়া উঠিল। হােসেন বলিল, নাও খােলাে, কুবির।

 খোঁটা হইতে নৌকার দড়ি খুলিয়া শম্ভু হাতে ধরিয়া রাখিয়াছিল, সে লাফাইয়া নৌকায় উঠিয়া পড়িল। আমিনুদ্দির মেয়ে যখন ঘাটে একেবারে জলের কিনারা পর্যন্ত আসিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল, নৌকা তফাতে সরিয়া গিয়াছে। বাপজান, বাপজান বলিয়া আকূল হইয়া মেয়েটা কঁদিতে লাগিল, নদীতে বুঝি সে ঝাঁপই দিয়া বসে। উলুপী ছাড়া ঘাটে স্ত্রীলােক নাই যে ওকে ধরিবে। উলুপী কলসি কাঁখে জল নিতে আসিয়াছে, আমিনুদ্দির মেয়েকে তাহার ছুঁইবার উপায় নাই। কিন্তু এখন সেকথা ভাবিবার সময় নয়। সেই মেয়েটাকে জড়াইয়া ধরিয়া রাখিল। আমিনুদ্দি হাঁকিয়া হাঁকিয়া মেয়েকে বলিতে লাগিল, সে ফিরিয়া আসিবে, দুদিন পরে নিশ্চয় ফিরিয়া আসিবে।

 মৃদু মৃদু বাতাস বহিতেছিল। শম্ভু ও বগা বাদাম তুলিয়া দিল। তারপর কেতুপুরের ঘাট দূর হইতে দূরে সরিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল। কুবের আমিনুদ্দির কাছে আসিয়া বলিল, মাইয়ারে কইয়া আস নাই?

 আমিনুদ্দি মাথা নাড়িল।

 দাঁড় বাহিবার প্রয়ােজন ছিল না, আস্তে আস্তে বাতাসের জোর বাড়িয়াছে, বাদাম উঠিয়াছে ফুলিয়া। কুবের এবার নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া নিজের রাজ্যপাট ও প্রজাপুঞ্জের দিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিল। রাজ্য প্রকাণ্ড, বসিবার শুইবার স্থানাভাব নাই, শুধু প্রজারা বড়াে অসুখী। মাঝবয়সি রমণীটি, পরিচয় নিয়া কুবের জানিতে পারিল রসুলের সে বােন, যাত্রার আগেই মৃদুস্বরে কঁদিতে আরম্ভ করিয়াছিল, কত গ্রাম তাহারা পার হইয়া আসিয়াছে, এখনও থাকিয়া থাকিয়া সে চোখ মুছিতেছে।

 বেলা বাড়িতে লাগিল। কুবের সকলকে জলখাবার বণ্টন করিয়া দিল। বাড়ি হইতে বাহির হইবার সময় মনটা খারাপ হইয়াছিল, এখন মন্দ লাগিতেছে না কুবেরের। নদীকে সে বড়াে ভালােবাসে, নদীর বুকে ভাসিয়া চলার মতো সুখ আর নাই। একে একে কতকগুলি লঞ্চ ও স্টিমার দুদিক হইতে ঢেউ তুলিয়া আসিয়া আগাইয়া যায়, সম্মুখের বােঝাই নৌকাগুলি পড়ে পিছনে। কোথাও নদীর একটি ছাড়া তটরেখা নাই, কোথাও অপর তীরের গাছপালা অস্পষ্ট চোখে পড়ে। কাউয়াচিলা পাখিগুলি ক্রমাগত জলে ঝাঁপাইয়া পড়িতেছে। বকেরা এখন একক শিকারি, সন্ধ্যায় আঁক বাঁধিবে। স্টিমার, নৌকা,