পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৭৯

 দেখা যায় বাইশ নম্বর মোটা লাইনটার উপরে, ওগুলি মানিক দ্বীপপুঞ্জ। চিনিতে পারিতেছে কুবের? আর ওই পুব-পশ্চিমের বাইশ নম্বর লাইন আর উত্তর-দক্ষিণের এই একানব্বই নম্বর লাইনটা যে বিন্দুতে পরস্পরকে অতিক্রম করিয়াছে, এই বিন্দুটির কিছু উত্তর-পূর্বে ওই যে একটি সবুজ বিন্দু দেখা যায় ওর নাম ময়নাদ্বীপ। জানে কুবের—ওরই নাম ময়নাদ্বীপ! আর ঘণ্টা দশেক নৌকা বাহিয়া তাহারা নোয়াখালির তীরভূমিকে পিছনে ফেলিবে, তারপর হাতিয়া ডাইনে রাখিয়া ধনমানিকদ্বীপ ছুঁইয়া, ধনমানিকদ্বীপ আর বাবনাবাদদ্বীপের যোগরেখার সঙ্গে বিয়াল্লিশ ডিগ্রি কোণ করিয়া পূর্ব-দক্ষিণে নৌকা বাহিলে একদিনে ময়নাদ্বীপে পৌঁছানো যাইবে।

 কুবের ভালো বুঝিতে পারে না। হা ঁকরিয়া নকশার রেখা ও লেখাগুলির দিকে চাহিয়া থাকে। কে জানে ওর মধ্যে মধ্যে ডাঙা ও জলের পার্থক্য কী কৌশলে আঁকা আছে, সে তো কোনো প্রভেদ বুঝিতে পারে না।

 হোসেন মিয়া যে কত বড়ো দক্ষ নাবিক, দিকচিহ্নহীন সমুদ্রের বুকে তাহার নৌকা পরিচালনা দেখিয়াই তাহা বোঝা গেল। সামনে একটা কম্পাস রাখিয়া সে হাল ধরিয়া বসিল, নৌকার ছয়জন মাঝি টানিতে লাগিল দাঁড়। সারাদিন পরে রক্তিম সূর্য সমুদ্রের জলে ডুবিয়া গেল, পূর্বে বহু দূরে কালো বিন্দুর মতো একটি দ্বীপ ছাড়া সূর্য শুধু দেখাইয়া গেল আকাশ ও জলরাশি। রাত্রেও দাঁড় টানার বিরাম হইল না, পালা করিয়া দুজন দুজন মাঝিকে দুঘণ্টা করিয়া ঘুমানোর অবসর দিয়া চারজনকে হোসেন সবসময়ে বসাইয়া রাখিল দাঁড়ে, নিজে এক মিনিটের জন্যও চোখ বুজিল না। নৌকার সকলে হয়রান হইয়া গেল, কুবেরের মনে হইতে লাগিল নৌকা বাহিয়া জীবনে সে আর কোনোদিন এত শ্রান্ত হইয়া পড়ে নাই।

 সকালবেলা দেখা গেল চারিদিক নিবিড় কুয়াশায় ঢাকিয়া গিয়াছে।

 হোসেন বলিল, বইঠা থোও কুবির, নোঙর ফেল।

 এতখানি কাছি টানিয়া নোঙর সমুদ্রের তলে গিয়া ঠেকিল যে কুবেরের মনে হইল নোঙরটা পাতালে গিয়া পৌঁছিয়াছে। কুয়াশায় নৌকা চালাইবার উপায় নাই, ধনমানিক দ্বীপের কাছাকাছি তাহারা আসিয়া পড়িয়াছে, কুয়াশায় দেখিতে না পাইয়া পাশ কাটাইয়া দূরে চলিয়া গেলে বিপদ হইবে; এই দ্বীপটির অবস্থান দেখিয়া তবে ঠিক করা যাইবে বাবনাবাদদ্বীপের সঙ্গে ইহার যোগরেখা, তারপর সোজা আগানো চলিবে কম্পাসের উপর নির্ভর করিয়া একেবারে ময়নাদ্বীপের দিকে। সারাদিন নৌকার অবস্থান বুঝিতে পারা যাইবে কি না সন্দেহ। অপেক্ষা করিতে হইবে রাত্রির জন্য। রাত্রে তারা উঠিলে ওই যে অদ্ভুত যন্ত্রটা আছে হোসেনের, ওই যন্ত্রের ভিতর দিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া তবে হোসেন বলিতে পারিবে কোনদিকে কতদূরে ধনমানিকদ্বীপ লুকাইয়া আছে।

 কী জানো মিয়া, কলের জাহাজ হলি, জানন যায় কত জোর চলতেছি, ঘণ্টায় কয় মাইল আলাম—সমুন্দুরের কোনখানে রইছি হিসাব করলি মেলে। নাও চালাইয়া জানুম