পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮২
পদ্মানদীর মাঝি

শুধু তাকেই হােসেন শাস্তি দেয়, ভীষণ ও মর্মান্তিক, যারা শত্রুতা করে হােসেনের, অকারণে ক্ষতি করিতে চায়, বিঘ্ন জন্মায় হােসেনের স্বপ্ন সফল হইবার পথে।

 কদিন কুবের দ্বীপ দেখিয়া ও দ্বীপের মানুষগুলির সঙ্গে ভাব করিয়া কাটাইয়া দিল। খেতের ধান সব কাটা হইয়া গিয়াছে, কিছু সরিষা, বুট ও মটর লাগানাে হইয়াছে, মূলা, পালং, কপি প্রভৃতি শাকসবজি গত বছর বাঁচিয়া থাকিতে চাহে নাই, এবছর কয়েক বিঘা জমিতে নূতন একপ্রকার সার দিয়া পরীক্ষার জন্য কিছু কিছু চাষ হইয়াছে, কী হইবে বলা যায় না।

 আরও ভিতরের দিকে দ্বীপের মাটি রবিশস্যের উপযােগী কিনা দেখিবার জন্য জঙ্গলের মধ্যে এখন অল্প একটু স্থান পরিষ্কার করা হইতেছে। সকালবেলা দা কুড়াল লইয়া একদল লােক জঙ্গলের মধ্যে মাইলখানেক হটিয়া যায়, নির্বাচিত স্থানটিতে গাছপালা ঝােপঝাড় কাটিয়া সাফ করে, শাবল দিয়া খুঁড়িয়া গাছের শিকড় তুলিয়া ফেলে, তারপর সারাদিন মশা ও পােকার কামড়ে শরীর ফুলাইয়া সন্ধ্যার সময় ফিরিয়া আসে। কুবের একদিন দেখিতে গিয়া শিহরিয়া ফিরিয়া আসিল। এই দ্বীপটির সৃষ্টির দিন হইতে যে বনভূমি কুমারী, তার বুকের এক খাবলা মাংস যেন সকলে ছিনাইয়া লইয়াছে, চারিপাশে নিবিড় বনের মাঝখানে পরিস্কৃত স্থানটুকু এমনই বীভৎস দেখায়।

 কয়েকদিন আগে কী একটা গােলমাল হইয়াছিল দ্বীপে, হােসেন উপস্থিত না থাকিলে অনেকে একত্র হইয়া জটলা করে, ভাসা-ভাসা দুটো একটা কথা কানে আসে কুবেরের। বিপিন নামে ষাট বছরের এক বৃদ্ধকে হােসেন এখানে মােড়ল করিয়াছে, তাকে ঘিরিয়াই জটলাটা জমাট বাঁধে বেশি, কুবের কাছে গেলেই কিন্তু সকলে চুপ করিয়া যায়। তারপর একদিন সন্ধ্যার সময় কাজকর্ম শেষ করিয়া সকলে যখন ঘরে ফিরিয়াছে, নিজের স্বতন্ত্র কুটিরের দাওয়ায় বসিয়া হােসেন প্রসন্ন মুখে টানিতেছে তামাক, বিপিন কথাটা ফাঁস করিল। বলিল, নালিশ আছে একটা।

 নালিশ? হােসেনের মুখ গম্ভীর হইয়া গেল।

 বিপিন ধীরে ধীরে ব্যাপারটা খুলিয়া বলিল। নারী-সংক্রান্ত লজ্জাকর ঘটনা। এনায়েত দ্বীপে আসিয়াছে মাত্র ছমাস আগে, ইতিমধ্যেই সে সকলকে বড়াে জ্বালাতন করিয়া তুলিয়াছে। প্রথম প্রথম এর সঙ্গে ওর সঙ্গে প্রায়ই তার কলহ বাঁধিত, একদিন নিরীহ দুর্বল গগন ঘােষকে মারিয়া সে জখম করিয়া দেয়, সকল মিলিয়া তখন খুব শাসন করিয়া দেয় এনায়েতকে। তারপর হইতে সে বেশ শান্তশিষ্ট হইয়াই থাকে, ব্যাপারটা তাই হােসেনকে জানানাে হয় নাই। কিন্তু কদিন আগে সে এক ভয়ানক অপরাধ করিয়া বসিয়াছে। বসির মিয়ার বউটি ছেলেমানুষ, কিছুদিন হইতে এনায়েত তাকে নাকি বিরক্ত করিতেছিল, ভয়ে বউটি কাহাকেও কিছু বলে নাই। তারপর একদিন দুপুরবেলা সকলে যখন কাজে গিয়াছে, এনায়েত বসিরের ঘরে প্রবেশ করে। বসিরের স্ত্রীর চেঁচামেচি শুনিয়া পাশের কুটিরের আকবরের স্ত্রী গিয়া পড়ায় বেচারি সেদিন ভালােয় ভালােয় রক্ষা পাইয়াছে।