পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৪
পদ্মানদীর মাঝি

নাই বসিরের—একটিও নয়। পাঁচ বছরে যে একটিও মানুষ বাড়াইতে পারিল না দ্বীপের, কয়েক বছরের মধ্যে যে প্রবেশ করিবে কবরে, তাকে দিয়া আর কী প্রয়ােজন আছে হােসেনের? বসির এবার তালাক দিবে তার বউকে। তারপর যথাসময়ে এনায়েতের সঙ্গে নিকা হইবে বউটির। একটি বউ আছে এনায়েতের, শীঘ্রই সে হােসেনকে উপহার দিবে একটি আনকোরা নতুন মানুষ—ময়নাদ্বীপের এক টুকরা ভবিষ্যৎ। তবুও আরও একটি বউ হােক এনায়েতের, সার্থক হােক দুজনের অন্যায় অসামাজিক প্রেম, পাঁচ বছর যে রমণী জননী হইতে পায় নাই তার কোল জুড়িয়া আসুক সন্তান, মানুষ বাড়ুক হােসেনের সাম্রাজ্যে।

 গ্রাম ছাড়িবার তিন সপ্তাহ পরে কুবের ও গণেশ গ্রামে ফিরিয়া আসিল। চাঁদপুরে তাহাদের নামাইয়া দিয়া হােসেন নৌকা লইয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে। হােসেনের মুসলমান মাঝিরা চাঁদপুরে অপেক্ষা করিতেছিল।

 গােপিকে নিয়া ইতিমধ্যে অনেক কাণ্ড হইয়া গিয়াছে। কুবের যেদিন চলিয়া গেল সেইদিনই গােপির পা ভয়ানক ফুলিয়া ওঠে। বাড়িতে পুরুষ কেহ নাই, কী করিবে ভাবিয়া না পাইয়া মালা কাঁদিয়া অস্থির হইয়াছিল। তারপর রাসু আসিয়া সব ব্যবস্থা করিয়াছে। কত যে করিয়াছে রাসু গােপির জন্য, শত মুখেও মালা তাহা বলিয়া শেষ করিতে পারিবে না। সেইদিনই গােপিকে রাসু আমিনবাড়ির হাসপাতালে নিয়া গিয়াছিল, রাত্রেই গােপির হাঁটুতে আবার অস্ত্র করা হয়। সে এখনও হাসপাতালে আছে, প্রায়ই রাসু তাহাকে দেখিতে যায়। ডাক্তার আশ্বাস দিয়াছে, হাড় ভাঙিয়া মাংসপেশির জট ছাড়াইয়া গােপির হাঁটু এবার ঠিক করিয়া দেওয়া হইয়াছে, একটু খোঁড়াইলেও সে হাঁটিতে পারিবে।

 কুবের ফিরিয়াছে খবর পাইয়া রাসু আসে। কুবের দুটো একটা কৃতজ্ঞতার কথা বলিতেই সে একেবারে গলিয়া যায়। মাথাটা একবার চুলকাইয়া রাসু কয়েকটা ঢোঁক গেলে। তারপর হঠাৎ বলিয়া বসে, গােপিরে দিবা মাঝি আমারে?

 কুবের গম্ভীর হইয়া যায়। বলে যে ব্যস্ততা কিসের? গােপি তো পড়িয়া আছে হাসপাতালে, আগে সে ফিরিয়া আসুক? রাসু তবু পীড়াপীড়ি করিতে থাকে। গােপির পা ভালাে হইয়া যাইবে শুনিয়া অবধি সে ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছে, এইসময় কুবেরের কাছে কথা আদায় করিয়া না রাখিলে পরে হয়তাে সে মত বদলাইয়া ফেলিবে। গােপির পঙ্গুতা আরােগ্য হওয়া যখন অনিশ্চিত ছিল তখন কথাটা পাকাপাকি করিয়া নেয় নাই বলিয়া বড়াে এখন অনুতাপ হইয়াছে রাসুর।

 শেষে কুবের বলে, কাইল কমু রাসু।

 রাত্রে সে পরামর্শ করিল মালার সঙ্গে। পরামর্শ করিয়া স্থির হইল যে, রাসু যদি দেড়কুড়ি টাকা পণ দেয় আর দুকুড়ি টাকার গহনা দেয় গােপিকে তবে এ বিবাহ হইতে পারে। তার কমে হইবে না।