আইনসঙ্গত মিলন। কী আশ্চর্য ভাগ্য লইয়াই এক-একটা লােক জন্মায় জগতে! বসিয়া থাকিতে থাকিতে পথ চলার শ্রান্তিতে ঢুল আসে কুবেরের। আধ-জাগা আধ-ঘুমানাে অবস্থায় সে স্বপ্ন দেখিতে থাকে, রচনা করিয়া চলে আকাশকুসুম। সর্বশক্তিমান হােসেনকে সে যেন বলিয়াছে, কপিলাকে পাইলে সপরিবারে সে ময়নাদ্বীপে গিয়া বাস করিবে—গণেশকেও বলিয়া সে রাজি করিবে যাইতে। হােসেন তাহার চিরন্তন হাসি হাসিয়া যেন বলিয়াছে, তাই করুম কুবির বাই, তাই করুম—আইনা দিমু কপিলারে। তারপর যেন একদিন—
কপিলা আসিয়া বলে, থাকবা নাকি মাঝি?
কুবের বলে, না।
দুইদিন থাইকা যাও? আইছ ক্যান কও দেহি?
সুবচনীর হাটে যামু মন কইরা বাইরইছি কপিলা। তা ভাবলাম তরে দেইখা যাই।
কপিলা মুচকি হাসিয়া বলে, সুবচনীর হাট নাকি আইজ?
কুবের বিবর্ণ হইয়া বলে, না?
হাটে গিয়া ঘুমাইয়া থাকগা মাঝি, কাইল হাট কইরা বাড়িত্ যাইও, বলিয়া কপিলা রান্নাঘরে চলিয়া যায়। কুবের উঠিয়া নামিয়া যায় উঠানে। লাউমাচার কাছে গিয়া সে দাঁড়ায়। লজ্জায় মুখখানাতে তাহার মাচার উপরকার উপুড় করা কালাে হাঁড়িটার ছায়া পড়ে যেন। কপিলার সঙ্গে সে কেন পারিয়া উঠিবে? পদ্মানদীর বােকা মাঝি সে, এক হাটে কিনিয়া কপিলা তাহাকে আরেক হাটে বেচিয়া দিয়াছে। অনেকদিন আগে।
দুপুরবেলা বাড়ি ফিরিয়া কুবেরকে দেখিয়া শ্যামাদাস খুশি হইল। দুজনে পুকুরে স্নান করিয়া আসিয়া একসঙ্গে খাইতে বসিল, অতিথি আসিয়াছে বলিয়া কপিলা আজ অনেক রান্না করিয়াছে। কিন্তু খাদ্যে কুবেরের রুচি ছিল না। কুবেরের হঠাৎ আসিবার কারণটা শ্যামাদাসও জানিতে চাহিল। কুবের এবার এক আশ্চর্য মিথ্যা রচনা করিয়া বসিল। হােসেন মিয়ার ময়নাদ্বীপে গিয়া বাস করিতে চাহিবে এমন যদি কেহ জানা থাকে শ্যামাদাসের? অনেক সুবিধা সেখানে বাস করার। বাড়িঘর অন্নবস্ত্র জমিজমা সব এখন বিনামূল্যে পাওয়া যাইবে, দশ-বিশ বছর পরে দ্বীপে বসতির বিস্তার হইলে তখন নামেমাত্র খাজনা ধার্য হইবে জমির, পুরুষানুক্রমে স্বত্ব জন্মিবে জমিতে। শ্যামাদাস যদি দশজনকে এই সুবর্ণ সুযােগের সংবাদ জানায় আর কেহ ময়নাদ্বীপে যাইতে রাজি হইলে কুবেরকে যদি খবর দেয়, বড়াে ভালাে হয় তবে।
শ্যামারাস অবাক হইয়া বলিল, চা বাগানের ঠিকাদারি নিছ নাকি মাঝি, আঁই?
চা বাগান? কিসের চা বাগান? শ্যামাদাস চলুক না, ময়নাদ্বীপ দেখিয়া আসিবে? আজই চলুক।
তুমি যাও না ক্যান ময়নাদ্বীপি? শ্যামাদাস জিজ্ঞাসা করিল।