পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৮৯

 কুবের থতোমতাে খাইয়া বলিল, যামু। আমিও যামু।

 আজ এখানে থাকিয়া যাওয়ার জন্য কুবেরকে অনেক অনুরােধ করিল শ্যামাদাস। কিন্তু থাকিবার উপায় কি আছে কুবেরের! গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া তাহাকে ময়নাদ্বীপের বারতা প্রচার করিতে হইবে।

 সুবচনীর হাটের ভিতর দিয়া আমিনবাড়ির পথ। হাটের শূন্য চালাগুলি খাঁ খাঁ করিতেছিল, পথের ধারে স্থায়ী দোকান ও আড়তগুলি শুধু খােলা আছে। একটা খাবারের দোকানের সামনে নড়বড়ে বেঞ্চিটাতে কুবের বসিয়া পড়িল। ভয়ানক শীত করিতেছিল কুবেরের, শরীরটা ছমছম করিতেছিল আর চোখ দুটো করিতেছিল জ্বালা। হুড়মুড় করিয়া জ্বর যে আসিতেছে অনেকক্ষণ আগেই সে তাহা টের পাইয়াছিল। বেঞ্চিটা রােদে সরাইয়া নিয়া চাদর মুড়ি দিয়া সে শুইয়া পড়িল। ক্রমে অপরাহ্ন হইয়া আসিল, দোকানের ছায়া কুবেরকে অতিক্রম করিয়া হাটের চালাগুলির মাথায় উঠিয়া গেল, কুবের তেমনিভাবে পড়িয়া রহিল বেঞ্চিটাতে। শেষে ময়রা তাহাকে ডাকাডাকি আরম্ভ করিয়া দিল।

 জ্বর আসিবার মুখে ভােজ খাইয়াছিল, অবস্থা বড়াে শােচনীয় হইয়া পড়িয়াছে কুবেরের। কপিলার স্বামী শ্যামাদাসের অবস্থা ভালাে বলিয়া, গরিব সে, জ্বর গায়ে পথে নামিয়া আসিয়াছিল, এত জ্বর যে আসিবে কুবের তা ভাবিতে পারে নাই। মাথার মধ্যে যেন কুয়াশা নামিয়াছে আর শব্দ হইতেছে গমগম। কোথায় কী অবস্থায় সে পড়িয়া আছে তাও মাঝে মাঝে গােলমাল হইয়া যাইতেছে সব—সমুদ্র তরঙ্গ, দুর্গাপূজার আলাে, অন্ধকার একটা চাঁচের বেড়ার বাহিরে সারি সারি ঘুমন্ত মানুষ, বারবার জাল নামানাে উঠানাে, ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা মাছের লাফালাফি সব একাকার হইয়া যাইতেছে। ময়রা মুখের চাদর সরাইয়া দিলে কুবের আরক্ত চোখে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকে, বিড়বিড় করিয়া বলে, শ্যামাদাসেরে খবর দিবা, আকুরটাকুরের শ্যামাদাস?

 সন্ধ্যার পর কুবের আবার ফিরিয়া গেল কপিলার কাছে, তাহাকে বিছানায় শােয়াইয়া একটা মােটা কাঁথা তাহার গায়ে চাপাইয়া দিয়া কপিলা রাঁধিতে গেল। অন্ধকার ঘরে কুবের শুইয়া রহিল একা।

 শেষরাত্রে ঘাম দিয়া কুবেরের জ্বর ছাড়িয়া গেল। সেই সঙ্গে ঘুমও ভাঙিয়া গেল তাহার, আর ঘুম আসিল না। একটা বিশ্রী বোঁটকা গন্ধে সে বড়াে অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল। অল্প অল্প আলাে হইলে সে উঠিয়া বসিল। ঘরখানা খুবই ছােট, ঘরের অর্ধেক জুড়িয়া পাটের স্তূপ আর দরজার কাছে প্রকাণ্ড একটা পাঠা বাঁধা, শুইয়া শুইয়া দাড়ি নাড়িয়া জাবর কাটিতেছে।

 শরীরটা বড়াে দুর্বল বােধ হইতেছিল কুবেরের। ধীরে ধীরে উঠিয়া সে বাহিরে গেল। কপিলা উঠানে গােবর লেপিতেছিল, বলিল, কিবা আছ মাঝি?

 কুবের ক্ষীণস্বরে বলিল, জ্বর নাই। আমি অখন যামু কপিলা।

 এখনই যাইবে কুবের, এই ভােরে? নাইবা গেল সে আজ দুর্বল শরীর লইয়া? একটু