পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯০
পদ্মানদীর মাঝি

সুস্থ হইয়া কাল গেলে হয় না? অন্তত কিছু খাইয়া যাক সে। এখনই দুধ দুহিয়া কপিলা জ্বাল দিবে, একটু দুধ খাইয়া যাক।

 না, কুবের কিছু খাইবে না। প্রয়ােজন নাই। পাঁঠা ও পাটের সৌরভে তার পেট ভরিয়া গিয়াছে। বিষন্ন মুখে কুবের মাথা নাড়ে। পদ্মানদীর কূল ছাড়িয়া দশ মাইল তফাতে চলিয়া আসিয়াছে সে, মন কেমন করিতেছে তার। পদ্মার বাতাস গায়ে না লাগিলে কেতুপুরের মেছাে গন্ধ না শুকিলে, সে সুস্থ হইবে না।

 কপিলা গােবর লেপা স্থগিত করিয়া বলে, গােসা করছ মাঝি? গােসা কইরাে না। ঘরভরা মাইনষের পাল, ঘর নি আছে আর তােমারে দিমু শােওনের লাইগা?

 কুবের বলল, হ রে কপিলা, হ। ব্যাজাল পাড়িস না, তর ব্যাজালে গাও জ্বলে।

 গাও জ্বলে মাঝি? গাও জ্বলে?

 হ, জ্বলে! গােরু ছাগল ভাবস আমারে তুই, খেলা করস আমার লগে। তরে চিনা গেলাম কপিলা, পরনাম কইরা গেলাম তরে।

 কপিলা ফিশফিশ করিয়া বলে, চুপ কর মাঝি, বেবাকে শুনব। যাইবা যাও, কী আর কমু তােমারে? এউক্‌কা কথা কইয়া দিই মাঝি, মাথা খাও, দিদিরে কথাডা কইও। কইও, কপিলা পরের ঘরের বউ, পরের শাসনে কপিলার মুখে রা-ও নাই। অতিথ্ কই থাকবাে, অতিথ্ কী খাইবাে, কপিলারে কেডা তা জিগায়? দুষি কইরাে মাঝি, শাইপাে—কিন্তু এই কথাডা কইও দিদিরে, মাথা খাও মাঝি, কইও।

 কার লগে কথা কস বউ?—ঘরের ভিতর হইতে শাশুড়ি জিজ্ঞাসা করে।

 কপিলা চাপা সুরে বলে, যাও গা মাঝি। ক্যান আইছিলা তুমি!


আমিনবাড়ির হাসপাতাল হইতে গােপিকে সঙ্গে করিয়া জলপথে কুবের গ্রামে ফিরিল। তাহার শীর্ণ চেহারা দেখিয়া মালা বারবার জিজ্ঞাসা করিল, কী হইয়াছিল তাহার, ফিরিতে এত দেরি হইল কেন? প্রশ্নগুলিকে এড়াইয়া গেল কুবের। অল্প সময়ের মধ্যে অকস্মাৎ অনেকগুলি বিচিত্র অভিজ্ঞতা কুবেরকে যেন নতুন মানুষ করিয়া দিয়াছে, নদী ও নদীতীরের একটানা জীবনে তাহার গত কয়েকটি মাস চিরস্মরণীয়। কোথায় ছিল কপিলা, কোথায় ছিল আশ্বিনের ঝড়, কোথায় ছিল ময়নাদ্বীপ! সব একসঙ্গে ভিড় করিয়া আসিয়াছে তাহার জীবনে।

 গ্রামে ফিরিয়া কুবের দেখিল, রাসু ইতিমধ্যে পীতমের সঙ্গে ভাব করিয়া ফেলিয়াছে। যুগীর ছেলে হইয়াছে, পীতমকে কে আর দেখিবে, কাজটা তাই পাইয়াছে রাসু। যুগীর মতাে রাসুকেও সে সর্বদা শাপান্ত করে, রাসু নীরবে সেবা করে বুড়ার। রাগও করে না, দুঃখিতও হয় না। রাসুর ধৈর্য দেখিয়া কুবের খুশি হয়, পীতম খুশি থাকিলে রাসু হয়তাে কিছু পাইবে টাকা-কড়ি, গােপিরই ভালাে হইবে তাহাতে। এমনকী, পীতমকে দেখিতে গিয়া তার কাছে রাসুর কিছু কিছু প্রশংসাও করিয়া আসে কুবের। বলে, মনটা ভালাে