পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯২
পদ্মানদীর মাঝি

আসিল এই নৌকায়, ছইয়ের মধ্যে পাটাতনের তলে হােসেন তাহা লুকাইয়া ফেলিল। তারপর হােসেন ও বৃদ্ধ মুসলমানটি নামিয়া গেল তীরে, গুনিয়া গুনিয়া হােসেন কতগুলি নােট তাহার হাতে দিল, নৌকায় ফিরিয়া আসিয়া বলিল, নাও খােলাে কুবির বাই।

 বড়াে কৌতুহল হইতেছিল কুবেরের। পাটাতনের নীচে কী লুকাইয়া রাখিয়াছে হােসেন? হােসেনকে প্রশ্ন করিবার সাহস কুবেরের হইল না। অনেক রাত্রে নৌকা বাঁধিয়া রাঁধিবার আয়ােজন করিবার সময় শম্ভকে সে চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করিল।

 শম্ভু বলিল, আপিম মিয়া, আপিম। চুপ যাও।

 আপিম? চুপিচুপি আপিমের ব্যাবসা করে হােসেন? এ তাে ভালাে কথা নয়! নানাদিকে কত উপার্জন হােসেনের, এইসব অসদুপায়ে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা কেন তার? তা ছাড়া চোরাই আপিমের ব্যবসা করা তাে সহজ বিপদের কথা নয়। ধরা পড়িলে কী উপায় হইবে তখন? কুবেরের ভয় করিতে লাগিল। হােসেন মিয়ার সঙ্গে যেদিন সে ভিড়িয়াছে সেইদিন হইতে সে জানে একদিন অনিবার্য বিপদ আসিবে, একেবারে সর্বনাশ হইয়া যাইবে। আজ কুবের বিপদের স্বরূপটা বুঝিতে পারিল। আজ হােক, কাল হােক, হাতে পড়িবে হাতকড়া, তারপর দু-দশ বছর জেলের বাহিরে কুবেরকে আর খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।

 ছইয়ের ভিতরটা হােসেন মিয়া দখল করিয়াছে, নৌকার উন্মুক্ত অংশে হােগলার ঢাকনি চাপাইয়া মাঝিরা শয়ন করে। শুইয়া শুইয়া কুবের অনেক আবােল-তাবােল চিন্তা করিল। একবার ভাবিল, এবার গাঁয়ে ফিরিয়া হােসেন মিয়ার নৌকায় আর সে কাজ করিবে না। জেলে যাওয়ার চেয়ে না খাইয়া মরাও ভালাে। কিন্তু না খাইয়া মরার সঙ্গে কুবেরের পরিচয় আছে। হােসেন মিয়ার সঙ্গে ভিড়িয়া জীবনে সে প্রথম সচ্ছলতার সুখ জানিয়াছে, এই কাজ ছাড়িয়া দিলে যে অবস্থা তাহার হইবে খানিকক্ষণ সে বিষয়ে চিন্তা করিয়া কুবের বুঝিতে পারে, জানিয়া শুনিয়া ইচ্ছা করিয়া দারিদ্র্যকে বরণ করিবার ক্ষমতা আর তাহার নাই। ক্ষোভে কুবেরের চোখে জল আসে। এ কী অন্যায় হােসেন মিয়ার! এইসব বিপজ্জনক কাজগুলি বাদ দিলেও তাহার তাে কাজের অভাব নাই, সেসব কাজে ব্যাপৃত না রাখিয়া কুবেরকে কেন সে এই বিপদের মধ্যে টানিয়া আনিয়াছে? তারপর কুবের ভাবে, এইসব ভয়ংকর কাজের সহায়তা যদি তাকে করিতে হয়, বিপদের ভাগ যদি তাহার থাকে, লাভের অংশও তাে তার পাওয়া উচিত? জেলে যাওয়ার ঝুঁকি যার সে কি শুধু বইঠা বাহিবার মজুরিই পাইবে?

 মনে মনে কুবের কলহ করে হােসেনের সঙ্গে। কল্পনায় সে বারবার এই ঘটনাগুলি ঘটাইয়া যায়। হােসেনের অন্যায়টা বুঝাইয়া দিতে সে ভারি অনুতপ্ত হয়, তাড়াতাড়ি কোমরের কালাে বেল্ট হইতে একতাড়া নােট নিয়া সে কুবেরকে দেয়। চার ভিটায় চারখানি বড়াে বড়াে ঘর তােলে কুবের, গােয়াল করে, ধানের মরাই করে, ঝাঁকার উপর লাউলতা তুলিয়া দেয়। তারপর একদিন কপিলাকে নিমন্ত্রণ করে। কপিলার পা দুটি জড়াইয়া