পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৯৭

ফিরাইতে পারে না। লঞ্চটি যখন ক্রমে ক্রমে কাছে আসিয়া পাশ দিয়া চলিয়া যায় কুবের শ্বাসরােধ করিয়া থাকে।


একদিন ভােরবেলা বাড়ি ফিরিয়া কুবের মালাকে দেখিতে পাইল না। গােপি বলিল, রাসুর সঙ্গে মালা আমিনবাড়ির হাসপাতালে গিয়াছে।

 কুবের রাগিয়া বলিল, কার নায়?

 বাবুগাে নায়।

 তিন দিন নদীর বুকে কাটাইয়া আসিয়াছে। মেজাজ গরম হইয়া ছিল কুবেরের। রাগে সে গুম খাইয়া রহিল। গােপি গড়গড় করিয়া ব্যাপারটা বিস্তারিত বলিয়া গেল। মালা কদিন হইতে রাসুকে তােষামােদ করিতেছিল, কাল মেজোবাবু মােকদ্দমার জন্য আমিনবাড়ি গিয়াছেন, সেই সুযােগে বাবুকে বলিয়া কহিয়া মালা ও রাসু সঙ্গে গিয়াছে।

 মেজোবাবু? মেজোবাবুর নৌকায় মালা আমিনবাড়ি গিয়াছে? মেয়ের দিকে কুবের কটমট করিয়া তাকায়। গােপিই যেন অপরাধিনী।

 গােপি ভয়ে ভয়ে বলে, লখা লগে গেছে বাবা।

 সারাদিন কুবের বাড়ি ছাড়িয়া নড়িল না। জীবনটা হঠাৎ তিতাে হইয়া গিয়াছে কুবেরের কাছে। সমস্ত সকালবেলাটা সে রাগে আগুন হইয়া রহিল, নিধু মাঝি আলাপ করিতে আসিলে তাহাকে অকথ্য গালাগালি করিয়া ভাগাইয়া দিল, বিনা দোষে মারিয়া চণ্ডীকে করিয়া দিল আধমরা। তারপর রাগ কমিয়া অপরাহ্ণে আসিল বিষাদ। কেবলই মনে হইতে লাগিল কুবেরের, মালা প্রতিশােধ লইয়াছে। কপিলার সঙ্গে সে কিনা একদিন আমিনবাড়িতেই রাত কাটাইয়া আসিয়াছিল, মালা তাই মেজোবাবুর সঙ্গে সেই আমিনবাড়িতেই গিয়াছে, হাসপাতালে যাওয়ার সেই একই উপলক্ষের ছল করিয়া।

 সন্ধ্যা হইল, মালা ফিরিল না। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়া আসিল হােসেন। কুবের ছাড়া বড়াে ঘরখানা হইতে সকলকে সরাইয়া দিয়া ঘরের মাঝখানের খুঁটি বাহিয়া উঠিয়া নিজে সে চালের খড় ফাঁক করিয়া ছােটো ছােটো দুটি বাণ্ডিল লুকাইয়া ফেলিল। খুঁটি বাহিতেও জানে হােসেন, গুণের লােকটার অন্ত নাই।

 কুবের নীরবে এই অদ্ভুত কাণ্ড চাহিয়া দেখিল, কিছু বলিল না। নামিয়া আসিয়া হােসেন বলিল, ডরাইও না কুবির বাই, ডর নাই।

 কুবের মুহ্যমানের মতাে মাথা নাড়িল।

 হােসেন বসিল। বলিল যে পুঁটুলি দুটি যতদিন সে না লইয়া যায়, কুবেরের ছুটি। সারাদিন বাড়ি বসিয়া আরাম করিবে কুবের, কেমন? চালে গোঁজা জিনিস দুটিকে সে পাহারা দিবে বটে কিন্তু বারবার ওদিকে চাহিবার প্রয়ােজন নাই কুবেরের। একেবারে না তাকানােই ভালাে। না, ঘরের চালায় কিছুই গোঁজা নাই কুবেরের। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়া আজ হােসেন তাহার বাড়ি আসে নাই, খুঁটি বাহিয়া উঠিয়া ঘরের চালে কিছুই সে গুঁজিয়া রাখে নাই।