পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৯৯

 তারপর কী কলহই দুজনে বাঁধিয়া গেল। প্রতিবেশীরা ছুটিয়া আসিল, দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল মজা। শেষে রাগের মাথায় কুবের হঠাৎ কলিকাটা মালার গায়ে ছুঁড়িয়া মারিল। কলিকার আগুনে মালা ও তাহার কোলের শিশুটির গা স্থানে স্থানে পুড়িয়া গেল, কাপড়েও আগুন ধরিয়া গেল মালার। সিধুর বােন ছুটিয়া আসিয়া কাপড়খানা টানিয়া খুলিয়া লইল, নিজের কাপড়ের আঁচল দিয়া লজ্জা নিবারণ করিল মালার। দুঃখিনী সে, বড়াে ছেঁড়া তাহার কাপড়খানা।

 স্ত্রী-পুরুষে ভীড় করিয়াছে অঙ্গনে, তাদের সামনে পঙ্গু অসহায় স্ত্রীর এই দশা, মালার দুরবস্থায় আমােদ পাইয়া সকলে হাসিয়াছে, কে যেন হাততালি দিল। এতক্ষণে চমক ভাঙিল কুবেরের। লাফাইয়া দাওয়া হইতে নামিয়া গাল দিতে দিতে সকলকে সে বাড়ির বাহির করিয়া দিয়া আসিল। তারপর নিজের একখানা কাপড় আনিয়া দিল মালাকে।


ক্রমে ক্রমে শীত কমিয়া আসিল।

 কেতুপুর গ্রাম ও জেলেপাড়ার মাঝামাঝি খালটা শুকাইয়া গিয়াছে। পদ্মার জলও কমিয়াছে অনেক। ক্রমে ক্রমে মাঠগুলি ফসলশূন্য হইয়া খাঁ খাঁ করিতে লাগিল, পায়ে চলা পথগুলি স্পষ্ট ও মসৃণ হইয়া আসিয়াছে অনেকদিন আগে। আমগাছে কচিপাতা দেখা দিয়াছে। দেখিতে দেখিতে পাখির সংখ্যা বাড়িয়া গিয়াছে দেশে। ঝাঁক বাঁধিয়া বুনাে হাঁসের দলকে উড়িতে দেখা যায়। উত্তরাভিমুখী নৌকাগুলি দক্ষিণের জোরালাে সমগতি বাতাসে বাদাম তুলিয়া তরতর করিয়া ভাসিয়া যায়, দূরে গেলে অতিথি হাঁসগুলির মতােই রহস্যময় মনে হয় তাদের। মাছ দুধ সস্তা হইয়াছে, পদ্মার চর হইতে কলসি-ভরা দুধ আসিয়া বাজারে চার পয়সা সের বিকাইয়া যায়।

 শীতে কুঁকড়ানাে গ্রামগুলি গা মেলিয়াছে। সকাল সন্ধ্যায় মালা কাপড় ভাঁজ করিয়া লখা ও চণ্ডীর শরীর ঢাকিয়া গলায় বাঁধিয়া দেয় না, খালি গায়েই তারা শুকনাে ডােবা পুকুরে কাদা ঘাঁটিয়া মাছ ধরিতে যায়। ফাটা চামড়া উঠিয়া গিয়া ত্বক মসৃণ হইয়া আসিতেছে সকলের, মালার রং যেন আরও ফরসা হইয়া আসিয়াছে, একমুষ্ঠি যৌবন যেন অতিরিক্ত আসিয়াছে মালার দেহে। মালাকে চাহিয়া রাত্রে কুবেরের ঘুম ভাঙে কোনােদিন গৃহে, কোনােদিন পদ্মার বুকে।

 রাসুর সঙ্গে গােপির বিবাহের বন্দোবস্ত কিন্তু হইয়া গিয়াছে বাতিল। এ কীর্তিও হােসেন মিয়ার। সােনাখালির একটি পাত্র হােসেন ঠিক করিয়া দিয়াছে গোপির জন্য। তার নাম বঙ্কু, বয়স বেশি নয়। এ জগতে বঙ্কুর আপনার কেহ নাই বটে কিন্তু হােসেন মিয়া আছে। হােসেন মিয়া যার মুরুব্বি, কিসের অভাব তার? বঙ্কু পাঁচকুড়ি টাকা পণ দিবে কুবেরকে, গােপিকে গহনা দিবে তিনকুড়ি টাকার, আর একদিন জেলেপাড়ার সকলকে দিবে ভােজ।

 একথা জানিতে কুবেরের বাকি নাই যে বিবাহের পর নবদম্পতিকে হােসেন ময়নাদ্বীপে লইয়া যাইবে, কিন্তু জানিয়া কী লাভ? হােসেন মিয়ার অবাধ্য কুবের কেমন করিয়া