পাতা:পশ্চিমের জানালা - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অভিব্যক্তি নিয়ে যত চুলচেরা বিশ্লেষণ কবি না কেন, তাতে নারী-পরিসরের উপস্থিতি তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে অনিবার্য হয়ে পড়ে এই প্রেক্ষিতে বোভোয়ার বিখ্যাত পাঠকৃতি বিশ শতকের অন্তিম দুটি দশকের আগে তেমনভাবে চিন্তাজীবী বাঙালির মননে । আলোড়ন তোলেনি। বাংলা সাহিত্যে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাট দশকে যে মার্কিনি ধাঁচের আভাঁ গাদ রচনাধারা দেখা দিয়েছিল, তাতে ইঙ্গ-ফরাসি ভাবনা-বলয়ের প্রভাব ছিল নামমাত্র। তাই সত্তর ও আশির দশকে যে কজন বাঙালি লিখিয়ে নিতান্ত বিচ্ছিন্নভাবে নব্য আভাগাদ প্রণালীর আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের লেখার জগও সাধারণভাবে পিতৃতান্ত্রিকতায় নিবিষ্ট। তাতে নারী-পরিসর নিয়ে কোথাও কোনও প্রপ্রিশ্ন উচ্চারিত হয়নি অর্থাৎ লৈঙ্গিক সংস্কৃতির মূলস্রোতের প্রতি যে-প্রত্যাশা তখন বোভোয়া-পরবর্তী পশ্চিম ইউরোপীয় চিন্তাবিশ্বে আপন উপস্থিতি ঘোষণা করছিল তার কোনও পরোক্ষ ছাপও বাঙালি লিখিয়েদের মধ্যে দেখা যায় না। এই অনুপস্থিতি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।

বোভোয়া ‘The force of circumstance’ (১৯৬৩) বইতে লিখেছিলেন: ‘Through literature one justifies the world by creating it ane in the purity of the imaginary, and by the same token, one justifies one’s existence.’ (New York : 1976 : 237)। যথাপ্রাপ্ত জগতের মধ্যে যত প্রচ্ছন্ন। স্ববিরোধিতা-অবভাস ও শূন্যায়তন রয়েছে, সংবেদনশীল নারীসত্তা সেইসব দ্বারা বিদ্ধ, আলোড়িত ও প্ররোচিত হতে থাকে। তখনই দেখা দেয়, পুনরাবিষ্কার ও পুনর্নির্মাণের তাগিদ। দৈনন্দিন অভ্যাসের মধ্য দিয়ে যে-জগৎ পরিচিত হয়, নানা ধরনের অভিজ্ঞতার। মধ্য দিয়ে অনুভূতিপ্রবণ নারী তাকে বহুস্তর-যুক্ত নির্মোক বলে বুঝে নেয়। তখনই অতীত ও বর্তমান, ধারণা ও জাগতিক বাস্তব, স্বাধীনতা ও রুদ্ধতার মধ্যবর্তী অদৃশ্য দেয়ালগুলি প্রকট হয়ে পড়ে। আর, তখনই সেইসবকে অস্বীকার ও পুনর্গঠন করতে নারীমন উৎসুক হয়ে পড়ে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে শুধু দার্শনিক বীক্ষার প্রসঙ্গ নেই, সাংস্কৃতিক রাজনীতির স্বরূপও নিহিত রয়েছে। বোভোয়ার দ্বিতীয় লিঙ্গ’ পাঠ নতুন বোধ ও কৃত্যের উদবোধনকেই অনিবার্য ও শানিততর করে তোলে।

গত ছয় দশক ধরে দেশ-বিদেশের তাত্ত্বিক, সমালোচক ও ভাষ্যকারেরা বোভোয়ার এই মহাগ্রন্থের সঙ্গে নারীচেতনাবাদ সহ অন্যান্য চিন্তাধারার বহুকৌনিক সম্পর্ক ও মিথস্ক্রিয়া নিয়ে নানা ধরনের বয়ান ও বিতর্ক তৈরি করেছেন। বোভোয়ার প্রবাদপ্রতিম। উক্তি ‘কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, ক্রমশ কেউ নারী হয়ে ওঠে’-এর অন্তর্বর্তী তাৎপর্যের বিছুরণ নিয়েও এত কথা বলা হয়েছে যে তা নিয়ে মন্তব্য নিম্প্রয়োজন। বলা বাহুল্যশিশুকাল থেকে শেষ নিঃশ্বাস পতন পর্যন্ত যেসব অস্তিত্ব ও অভিজ্ঞান নারী হিসেবে সুনির্দিষ্ট ও পুনঃ পুনঃ ঘোষিত, পরিবারের ভেতরে এবং বাইরে সমাজ ও তার সঞ্চালক ইতিহাস-ভাবাদর্শ-মূল্যবোধ প্রচ্ছন্ন ও প্রকাশ্যভাবে নারী-অবস্থানের সেই চিহ্নায়কগুলিকে ক্রমশ দুর্ভেদ্য করে তোলে। বোভোয়া যে নারীচেতনাবাদী ইতিহাস-লিখনপদ্ধতিকে তার বইতে অজস্র অনুপুর্য ও বিশ্লেষণের সাহায্যে সুপ্রতিষ্ঠিত ১১৫