পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৪৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শীলাদেবী
৪৯১

আমরা যতটা বুঝিতে পারি তাহাতে অনুমিত হয় যে সেই পালাটিই খাঁটি ছিল এবং বর্ত্তমান পালাটিতে রচয়িতা ইচ্ছাপূর্বক কতকগুলি পরিবর্তন সাধন করিয়াছেন। শীলা দেবীর পিতা পলাইয়া যে রাজার নিকট গিয়াছিলেন, এই পালাটিতে তাহার নাম বা কোন পরিচয় নাই। কিন্তু আমার বিশ্বাস ব্রাহ্মণ-রাজা গাজীদের নিকটই সাহায্য প্রার্থনার জন্য প্রথম গিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণ্য-প্রভাবের আতিশয্যে দ্বিতীয় পালা-লেখক মুসলমান-সংশ্লিষ্ট ঘটনাটা গোপন করিয়াছেন এবং তৎস্থলে একটি অজ্ঞাতকুলশীল অনামা হিন্দুরাজাকে আনিয়া সে স্থান পূরণ করিয়াছেন। এই পরিবর্তন স্বেচ্ছাকৃত। পূর্ব্বকালে ত্রিপুরার রাজারা গাঙ্গেয় উপত্যকার উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের সঙ্গে বৈবাহিক আদান-প্রদানের জন্য লালায়িত ছিলেন, ইহা অনেকেই জানেন। সুতরাং ত্রিপুরার যুবরাজের ব্রাহ্মণকুমারীর পাণিপ্রার্থী হওয়া বিচিত্র নয়।

 যদিও বর্ত্তমান পালাটি সম্ভবতঃ এইভাবে পরিবর্ত্তিত হইয়াছে, তথাপি মূল পালার সহিত ইহার ভাব ও ভাষাগত যে খুব বেশী পার্থক্য আছে ইহা আমার মনে হয় না। যে আকারে এই পালাটি পাইতেছি, তাহা পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে কিংবা ষোড়শ শতাব্দীর পূর্ব্বভাগে বিরচিত হইয়াছিল, ইহাই আমাদের ধারণা।

 মুণ্ডার চরিত্রটি যথাযথভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে। অল্প কথায় একটা লৌহবক্ষ বৃষস্কন্ধ মহাতেজস্বী অসভ্য বীরের আকৃতিটি আমাদের চক্ষের সম্মুখে উপস্থিত করা হইয়াছে। তাহার স্পৰ্দ্ধা, তেজ এবং চক্রান্ত করার শক্তি একটা ভীষণ বন্য শার্দ্দুলেরই অনুরূপ। শীলদেবী এবং যুবরাজের প্রেম-কাহিনী একটি দুর্ঘটনাময় আঁধার রাজ্যের মধ্যে বিদ্যুৎ-স্ফুরণের ন্যায়। মামুলী বারমাসীটি আছে এবং স্থানে স্থানে গ্রাম্য পাণ্ডিত্যের চিহ্ন দেখিয়া মনে হয় পালার লেখক নব ব্রাহ্মণ্য-প্রভাবের হাত একেবারে এড়াইতে পারেন নাই। বারমাসী এবং প্রেমকাহিনী একটু অতিরিক্ত মাত্রায় দীর্ঘ হইয়াছে; তথাপি তন্মধ্যে যথেষ্ট পল্লী-সৌন্দর্য্যের প্রভা বাড়িয়াছে। মোটামুটি বলিতে গেলে পালাটি প্রাচীন ভাল পালাগুলির সঙ্গে এক পঙ্‌ক্তিতে স্থান লইবার দাবী করিতে পারে এবং ভাষাও অনেকটা প্রাচীন আদর্শেরই অনুরূপ। প্রাচীন পল্লীগুলির তৎসাময়িক যে চিত্র দেওয়া হইয়াছে তাহার