পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৪৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৯৪
পূর্ববঙ্গ গীতিকা

গেল। রাজা উন্মত্তের ন্যায় সেই অমূল্য স্মৃতিচিহ্ন হাতে লইয়া স্বৰ্গগামিনীর পথের দিকে চাহিয়া রহিলেন। এই চিত্রের উপরে কবি পটক্ষেপ করিয়া পাঠকের মনে জানকীনাথের যে মূর্ত্তি আঁকিয়াছেন তাহা কখনই মুছিয়া যাইবার সম্ভাবনা নাই।

 বর্ত্তমান পালাটি সেই পালারই উপসংহার এ কথা আমরা বলিয়াছি। ইহা অধরচন্দ্রের লেখা নহে। অজ্ঞাতনামা কবি এই পালাটিতেও তাঁহার বিলক্ষণ শক্তির প্রমাণ দিয়াছেন। চিরশত্রু জানকীনাথের মৃত্যুসংবাদ শুনিয়া ভুঁইয়াদের নায়ক জঙ্গলবাড়ীর ইশা খাঁ তখনই দুর্গাপুর অধিকার করিতে সসৈন্যে রওনা হইলেন। তখন রঘুনাথ পঞ্চ বৎসর বয়স্ক মাত্র। তঁহার পিতার চিরবিশ্বস্ত মন্ত্রীরা তঁহাকে সিংহাসনে বসাইয়া রাজ্য পরিচালনা করিতেছিলেন। ইশা খাঁর সৈন্যেরা ঐ সময়ে পুরী অবরোধ করিল। বহুদিনের চেষ্টায় ছলে বলে শত্রুরা পুরীতে ঢুকিয়া শিশুরাজাকে বন্দী করিয়া লইয়া গেল।

 এই সংবাদ প্রজাদের মধ্যে রাষ্ট্র হওয়ায় পরে যে শোকোন্মত্ততা দেখা দিল, তাহা করুণ রসের বন্যা; বিশেষতঃ যখন সহস্ৰ সহস্র গারোসৈন্য ভীষণ জলপ্রপাতের ন্যায় পাহাড় হইতে নামিয়া তাহদের শিশু রাজার জন্য উন্মত্তভাবে শোকপ্রকাশ করিয়া প্রতিশোধ লইবার সঙ্কল্প জানাইল তখনকার সে দৃশ্য উত্তেজনাপূর্ণ। হিন্দুরাজ্যে প্রজারা যে কিরূপ রাজভক্ত ছিল, এই পালা-গানটি পড়িলে তাহা বুঝা যায়। গারোরা দোর্দণ্ড প্রতাপে বর্শা ও খড়্গ লইয়া জঙ্গলবাড়ীর দিকে ছুটিল। তাহারা হয় শিশু-রাজাকে উদ্ধার করিয়া আনিবে, নয়। প্রাণ দিবে—এই তাহাদের সঙ্কল্প।

 তখন দুৰ্গাপুরে রাজকুমারকে বন্দী করার আনন্দে ইশা খাঁর প্রজামণ্ডলী নানা প্রকার আমোদ-প্রমোদে ব্যস্ত। জঙ্গলবাড়ীর নিকটে এক দুর্ভেদ্য অরণ্য ছিল। ত্রিশ হাজার গারো তথায় জড় হইয়া একটা খাল কাটিয়া ফেলিল। এই খাল দ্বারা তাহারা রাতারাতি ধনেখালি নদীর সহিত জঙ্গলবাড়ীর পরিখার সংযোগ সাধন করিল। ইশা খাঁর নিযুক্ত রক্ষীদের অজ্ঞাতসারে তাহারা শিশু-রঘুনাথকে উদ্ধার করিয়া ইশা খাঁরই বড় পিনিসে বহু লোকে দাঁড় টানিয়া তাঁহাকে দুৰ্গাপুরে লইয়া আসিল। বহুহস্ত-