পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৫১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫১২
পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা

সতীত্বের ডঙ্কা এরূপ জোরে বাজিয়া উঠিয়াছে যে এরূপ একটা প্রেমকাহিনীর অস্তিত্ব অসম্ভব বলিয়া মনে হইতে পারিত যদি না ইহা আমরা চাক্ষুষ দেখিতাম। এই কুল-কলঙ্কিনী লোকলোচনে অতীব বিসদৃশ,―ইহার প্রতি কাহার সহানুভূতি থাকিতে পারে! কিন্তু হিন্দু সমাজের বৃদ্ধ অভিভাবকগণ নীতির তুলাদণ্ড ধরিয়া একদিকে সূক্ষ্ম বিচার করিতেছেন, অপর দিকে সেই রসস্বরূপ আনন্দময়ের প্রেমের সঙ্গীত অবলীলাক্রমে নীতিশাস্ত্রটাকে উলট পালট করিয়া দিতেছে এবং ঠিক একটা খেলনার মত তাহা ভাঙ্গিয়া চুরিয়া আবদার করিতেছে। শিশু যদি একটা মহামূল্য জিনিষ ভাঙ্গে তবে মাতা কি করেন? দুই মিনিট পরে তাহার চক্ষের জল মুছাইয়া তাহার গণ্ডে চুম্বন করেন। এই কবি সেইরূপ আবদারে। তাঁহার অকাণ্ডটাতেও আমরা অপূর্ব্বত্ব আবিষ্কার করিয়া তাহার উচ্চমূল্য দিতে স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছি। রাজকুমারী কুল ছাড়িলেন কি স্বামী ছাড়িলেন, ঐশ্বর্য্য ছাড়িলেন কি কাঙ্গালিনী হইলেন, এ সকল কথা আমরা ভুলিয়া যাই; আমরা তাঁহার একখানি মাত্র চিত্র দেখি, তাহা ইন্দ্রিয়াতীত, শুদ্ধ, অপাপবিদ্ধ, অমৃতময় ও লোকাতীত―এই প্রেম স্বর্গের, ইহা পৃথিবীর নীতির মানদণ্ডে তুলিত হইবার নয়। স্বামি-কলঙ্কিনীর এই ব্যভিচার সম্পূর্ণরূপে অনাবিল। কবি এত বড়, যে প্রচলিত লৌকিক নৈতিক আদর্শ তিনি অনায়াসে ডিঙ্গাইয়া চলিয়া গিয়াছেন―তিনি যে রাজ্য হইতে তাহার সুর শুনাইতেছেন, মর্ত্ত্যের মানুষ সেই রাজ্যের বিচারক নহে। তাঁহার গান শুনিবার যোগ্য ক্ষ্যাপা ভোলা,―সম্পূর্ণরূপে তন্ময় অপার্থিব ব্যক্তি। তাঁহার গানের বোদ্ধা সেই ব্যক্তি যিনি কাঞ্চন ও কাচকে তুল্য মনে করেন, যিনি পথের ধূলি কুড়াইয়া মাথায় রাখেন ও মণিমাণিক্য তৃণবৎ জ্ঞান করিয়া আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেন। যেমন রাজকুমারী তেমনি তাহার আন্ধাবন্ধু―দুইই দেহের প্রতি উদাসীন, দুইই দেহাতীত কিছু পাইয়াছে―ও তাহাই জগৎকে দিতেছে,―যাহা পাইয়া রমণী সতীত্বকুম্ভ জলে ভাসাইয়া দিয়া কুলত্যাগিনী হইতেছে, তাহার অসমসাহসিক গতির দ্রুত ছন্দের পশ্চাতে সংসারের শত শত কর্ত্তব্যের বাঁধ মাকড়শার জলের মত ছিন্নভিন্ন হইয়া অসার হইয়া পড়িতেছে।