ষড়-ঋতুভেদে বঙ্গমাতার রূপ ও বেশপরিবর্ত্তন আমাদের চক্ষে লাগিয়া রহিয়াছে। এই সকল বারমাসীর প্রত্যেকটিতেই আমাদের চক্ষে যে পল্লীচিত্র প্রকাশিত হয় তাহা চিরপুরাতন হইয়াও নিত্যনূতন।
আমরা আন্ধাবন্ধু-পালায় স্ত্রীলোকের যে অসম সাহসের পরিচয় পাইয়াছি, অন্য এক ভাবে বগুলার পালায়ও স্ত্রী-স্বাধীনতার মৃদুতর একটা নিদর্শন দেখিতে পাই। স্বামী প্রবাসী, তাঁহার ধর্মপত্নী অপর এক প্রণয়ীর সহিত চিঠিপত্রে ভালবাসা জ্ঞাপন করিতেছেন। অবশ্য বণিক্-কুমারী বগুলা একান্ত শুদ্ধ-চরিত্রা এবং যাহার সহিত তাঁহার পত্রব্যবহার চলিতেছে তাহাকে তিনি জানিয়া শুনিয়া প্রতারণা করিতেছেন। এমন কি যখন রাজপুত্র তাঁহাকে লিখিয়া পাঠাইলেন যে তাঁহার স্বামী নৌকাডুবি হইয়া মারা গিয়াছেন, তখন বগুলা নিঃসঙ্কোচে লিখিলেন―“আমার স্বামী যদি মরিয়া গিয়া থাকেন তাহাতে আমার লাভ ভিন্ন লোকসান নাই, কারণ তোমার মত রাজকুমারকে আমি স্বামি-স্বরূপ পাইব।” বগুলা জানিতেন যে এইরূপ প্রতারণা করিয়া রাজপুত্রকে নিবৃত্ত না করিলে দুষ্টপ্রকৃতি, ঐশ্বর্য্য-মদমত্ত যুবক তাঁহার স্বামীর প্রাণ হরণ করিবে। স্বামীকে নিরাপদ্ রাখিবার জন্যই বগুলা এই সকল ধূর্ত্ততা অবলম্বন করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা হইলে কি হয়? একটি কুলবধূর পক্ষে ক্রমাগত―কখনো দাসীর হাতে কখনো বা কপোতের মুখে এইরূপ প্রতারণামূলক পত্রব্যবহার আধুনিক সমাজ-নিয়মের একান্ত বিরোধী। প্রাচীন-পালা-গায়কগণ আশ্চর্য্য অন্তর্দৃষ্টিবলে কেবলই নরনারীর হৃদয়ের সাধুত্বের সন্ধান করিতেন এবং তাহারই ছবি আঁকিয়া যাইতেন। সমাজের যে একটা প্রকাণ্ড লৌহযন্ত্র মানবচিত্তকে নিষ্পেষণ করিবার জন্য অগ্নিচক্ষে স্ফুলিঙ্গ বিকীর্ণ করিত, সে দিকে পালারচক একবারও ভ্রূক্ষেপ করিতেন না। এই বীর্য্য এবং তেজ অনন্যসাধারণ। তবে এমনও হইতে পারে যে বাঙ্গালার প্রান্তসীমায় তখনও ব্রাহ্মণ্য প্রভাবের এত কড়াকড়ি অনুশাসন হয় নাই। আমরা পূর্ব্বে অনেকবার লিখিয়াছি পুর্ব্ব-মৈমনসিং প্রভৃতি অঞ্চলে বহুকাল পর্য্যন্ত কনৌজিয়া ব্রাহ্মণদের প্রভাব ঢুকিতে পারে নাই। এই সকল স্ত্রী-স্বাধীনতার চিত্র দেখিয়া মনে হয় যে উত্তরে গারো পাহাড় ও পূর্ব্বের ব্রহ্মদেশ এই দুই