ব্যাকরণ, সাহিত্য ও পুরাণাদি শিক্ষা দিয়াছিলেন। ‘কেনারামের’ পালায় আমরা বংশীদাসের যে উজ্জ্বল ছবিটি পাইয়াছি—নয়ানচাঁদ কবির হস্তে তাহা আরও সমুজ্জ্বল হইয়াছে। বংশীদাস অতি দরিদ্র ছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন পরম ভক্ত ও একনিষ্ঠ সাধক। তিনি ব্রাহ্মণ্যগৌরবের স্তম্ভস্বরূপ ছিলেন। চন্দ্রাবতী তাঁহার যে চরিত্র দিয়াছেন তাহা জীবন্ত। নামাবলী, উত্তরীয়, আবক্ষোলম্বিত রুদ্রাক্ষমালা, সুদীর্ঘ গৌর বপু, এই ছিল তাঁহার সরঞ্জাম। তিনি যখন তন্ময় হইয়া গান করিতেন তখন আরণ্য প্রদেশে পক্ষীদের কাকলী থামিয়া যাইত ও তাহারা উড়িয়া আসিয়া তাঁহার নিকটে ডালের উপর বসিয়া মুগ্ধভাবে চুপ করিয়া থাকিত। এ দিকে গৃহে অন্ন নাই, গান গাহিয়া কিছু তণ্ডুল ও কড়ি তিনি সংগ্রহ করিতেন, কিন্তু নিত্যকার প্রয়োজনীয় যেটুকু, তাহার বেশী অর্থ লইতে স্বীকৃত হইতেন না। যখন কেনারাম দস্যু বহু কলসী স্বর্ণমুদ্রা তাঁহাকে উপঢৌকন দিয়া বলিল, অনেক পুরুষ পর্যন্ত আর আপনাদের অর্থাভাব হইবে না, তখন সগর্ব্বে বংশীদাস বলিলেন, “এই নররক্তরঞ্জিত অর্থ আমার চক্ষের সম্মুখ হইতে লইয়া যাও, উহা গ্রহণ করা দূরে থাক, দর্শন করাও আমার পাপ।” সেই দিন কেনারাম দস্যু প্রথমে হতবুদ্ধি হইল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বুঝিল সংসারে অর্থ হইতেও মূল্যবান্ জিনিষ আছে। ক্ষিপ্রহন্তে উন্মত্তের ন্যায় কলসী কলসী স্বর্ণমুদ্রা সে ফুলেশ্বরী নদীর জলে নিক্ষেপ করিয়া রিক্তহস্ত হইল, এবং কাঁদিয়া বংশীদাসের নিকট ধর্ম্মোপদেশ প্রার্থনা করিল। যে খড়্গ লইয়া সে বংশীদাসকে কাটিতে উদ্যত হইয়াছিল, বহুকাল সঞ্চিত সেই বিপুল অর্থের সঙ্গে সে খড়্গখানিও চিরতরে ফুলেশ্বরীর জলে বিসর্জ্জন দিল। জীবনে সে আর লৌহাস্ত্র ধারণ করে নাই।
মলুয়া ও কেনারামের পালায় চন্দ্রাবতী যে অসামান্য প্রতিভার পরিচয় দিয়াছেন এই রামায়ণের পালায়ও সেই প্রতিভার যথেষ্ট পরিচয় আছে। ইহা যেমনি সরল, তেমনি করুণ। শ্রেষ্ঠ পালাগায়কদের যে অতি সংক্ষেপে মনোভাব প্রকাশ করিবার কৃতিত্ব দেখা যায় এই রামায়ণের পালায়ও সেই কৃতিত্বের পরিচয় আছে। এত ক্ষুদ্র আকারে এরূপ সরলভাবে রামায়ণের গল্প সম্ভবতঃ আর কেহ বর্ণনা করেন নাই। মলুয়া, কেনারাম